ডঃ আবুল কালাম আজাদ:
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকেরা জানেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনে ভারত সব সময়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আগেও করেছে, এখনও করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত আগে থেকেই যা খেলেছে ও খেলছে তা দেখে যে কেউ বলতে পারেন যে, বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বিষহারা সাপ আর ভারত হচ্ছে এক পাকা সাপুড়ে।
আমরা জানি, ভারতের এই ধরণের খেলাতে কারোরই লাভ হয় নি, বা হবেও না। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত যত কাল এই ধরণের অনর্থক বাজিকরের খেলা খেলবে তত দিন এই অঞ্চলে প্রকৃত শান্তি আসবে না।
আমরা জানি, ভারতে অনেক শান্তি প্রিয় ও পন্ডিত মানুষ আছেন, আছেন মেধাবী রাজনীতিবিদ।
তাদের কাছে আমাদের অনুরোধঃ শুধু মাত্র একটি দল বা পরিবারকে নয়, আপনার সারা বাংলাদেশটাকেই আপনারা আপনাদের বন্ধুর মত দেখুন।
ইউরোপের দেশ গুলো দেখুন, তারা কতো কাছা কাছি এসে একটা শক্তিশালী ইউনিয়ন করে নিজেদের মুদ্রা পর্যন্ত এক করে ফেলেছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের একটা অমূলক ভয় হলো- এখানকার ইসলামপন্থীরা তাদের জন্যে একটা বিরাট হুমকি ও ভয়ংকর ব্যাপার। আসলে কিন্তু এই ভয়টা একটা জুজু বুড়ির ভয়ের মতই কাল্পনিক। কারণ, ভারতের নীতি নির্ধারকদের ভালো করেই জানার কথা যে, বাংলাদেশের ইসলাম পন্থীরা চারভাগে বিভক্ত এবং এই চার ধরণের প্রত্যেকের সাথে ভারতের একটা গভীর শ্রদ্ধামূলক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক আছে। এই ইসলামপন্থীরা কিন্তু ভারত বিরোধী নন বা ভারতের শত্রু নন। তারা কিন্তু পাকিস্তানেরও বন্ধু নন। বরং বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা কিন্তু পাকিস্তানের চেয়ে ভারত বা ভারতীয়দের অতি কাছের। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবেই ভারত নিজেই এই বিশাল ইসলামীক জনগোষ্ঠীকে তাদের শত্রু মনে করে তেতিয়ে তুলেছে।
আমি সংক্ষেপে এই চার ধরণের ইসলাম পন্থীদের সাথে ভারতীয় সম্পর্ক তুলে ধরবঃ
১- বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের সবাই হলেন দেওবন্দী তরীকার। আর একথা সবাই জানেন যে, দেওবন্দের সাথে কংগ্রেসের সম্পর্ক অনেক পুরানো ও ঐতিহাসিক। বাংলাদেশী দেওবন্দীরা কিন্তু পাকিস্তানপন্থী ছিলেন না, তারা ছিলেন ভারতপন্থী। এই উলামারা বাংলা ভাষার চেয়ে উর্দুকে বেশী ভালোবাসেন এবং আরব উলামাদের চেয়ে ভারতীয় উলামায়ে কেরামকে তারা বেশী মূল্যায়ন করেন। কিন্তু ভারত অহেতুক ইসলাম ভীতির কারণে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী দেওবন্দপন্থী উলামায়ে কেরামকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
২- তাবলীগ জামায়াতের উৎপত্তি ভারতে এবং বাংলাদেশী লক্ষ লক্ষ তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ভারতীয় উলামা ও ভারতের প্রতি প্রীত ও শ্রদ্ধাশীল। যদিও তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বাহ্যিকভাবে কোন রাজনীতি করেন না। কিন্তু ভোটের সময় তারা কিন্তু ভারতীয় প্রীতিকে অবজ্ঞা করেন না।
৩- জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন সময়ের ভূমিকা দেখে মনে হতে পারে যে তারা ভারত বিরোধী। কিন্তু শুরু থেকেই ভারত এই বিশাল জনশক্তিকে কাছে টানার চেয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিজেদের বিরোধী বলয়ে সরিয়ে দিয়েছে। জামায়াতও ভালো করেই জানে, যে পাকিস্তানের পক্ষে তারা সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশে তারা বিতর্কিত ও সাজা প্রাপ্ত হচ্ছে সেই পাকিস্তানও বাংলাদেশের জামায়াতকে বন্ধু মনে করে না। সে ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশ জামায়াতকে কাছে নিলে ভারতেরও কোন ক্ষতি ছিলো না আর জামায়াতও হয়ত একটা আঞ্চলিক বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারতো। কারণ, জামায়াতে ইসলামীরও বুঝার কথা যে, বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ভারতের সাথে সুসম্পর্কের কোন বিকল্প নেই।
৪- বাংলাদেশের উত্তারঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী আহলে হাদীস। তাদেরকে বাহ্যিকভাবে ওয়াহাবী মনে করলেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতকে তারা শত্রু মনে করে বলে প্রমাণ নেই। কারণ, আহলে হাদীসের বিশেষ কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। তাই, তারা ভারতের সাথে কোন প্রকার শত্রুতা রাখার দরকার মনে করে না।
বিএনপিকে অনেকেই ভারত বিরোধী মনে করলেও তারা ক্ষমতায় থাকার সময় ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছে।
ভারত হয়ত মনে করতে পারে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান, আর ভারত হিন্দু প্রধান দেশ। আর হিন্দু-মুসলমানরা হলো তেল ও পানির মত; কোন দিন এক হতে পারে না।
আমি কিন্তু এই তত্ত্বের সাথে একটুও একমত হতে পারি না। কারণ হলো বাংলাদেশের যশোর জেলার যে গ্রামে আমার শৈশব কেটেছে সেই গ্রামের প্রায় চার ভাগের একভাগ বাসিন্দা হলেন হিন্দু। আমাদের গ্রাম সহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক দেখেছি তাতে আমি পরিপূর্ণ আস্থাশীল যে, শুধু মাত্র গ্রামের হিন্দু-মুসলমানরাই মিলেমিশে থাকতে পারে তাই নয়, দুই দেশের হিন্দু-মুসলমানরাও এক সাথে বন্ধুর মত বা সুন্দর প্রতিবেশীর মত জীবন চালাতে পারবে।
এজন্যে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রজ্ঞা। আমার অনুশীলনী মুসলিম বাবা যদি গ্রাম্য রাজনীতির প্রজ্ঞা দিয়ে হিন্দু দেরকে মামা-মামী বানিয়ে এক পিড়ায় উঠাবসা করতে পারেন তাহলে দুদেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতিবিদরা কেন বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশী হয়ে থাকতে পারবেন না?
যারা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নীতি নির্ধারণ করেন বা পরামর্শ দেন তারা যদি ইতিবাচক মনোভাব ও গভীর অনুধ্যয় নিয়ে বিষয়টা দেখতেন তাহলে পুরো ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হতে পারত।
ভারতের প্রতি তাই বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিম জনতার পক্ষ থেকে আমাদের আবেদন, আমাদেরকে শত্রু ভেবে সাপের মত না খেলিয়ে ও না ক্ষেপিয়ে আমাদেরকে ভাই ও বন্ধুর মত আচরণ করুন। শুধু মাত্র একটা দল ও পরিবারকে আপনাদের বন্ধু মনে না করে, আপনাদের মনের প্রশস্ততা দিয়ে সমস্ত বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীকেই আপনাদের বন্ধু বানিয়ে নেন। আমরা গরীব। তাই, এই উদ্যোগটা আপনাদেরকেই আগে ও বেশী করে নিতে হবে। তাহলে, আপনারা-আমরা চিরকাল এক সাথে মিলে-মিশে রাজনৈতিক শান্তিতে থাকতে পারব।
আসুন, আমরা নতুন ভাবে চিন্তা করে একযোগে কাজ করে নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দেই। যা শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই নয়, বরং সারা দুনিয়ার জন্যে আঞ্চলিক ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে।