আবদুল্লাহ আল ফারুক: অভূতপূর্ব এক সংকটে এখন দেশ। সংঘাত, সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরীহ মানুষকে খুন। সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে বর্বরোচিত নির্যাতন। সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, তাদের ওপরও আসছে আঘাত। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। ঘর থেকে বের হতেও অনেকে ভয় পাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে এত দিন বিরোধ মূলত রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল। তবে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে সংকট সামাজিক থেকে শুরু করে ব্যক্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। এ বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ তাকিয়ে আছে দুই নেত্রীর দিকে। তারা বলছে, এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঐকমত্যেই সমাধান নিহিত।
এ নিয়ে প্রধান দুই দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, সংকট দূর করতে সরকারকেই এগিয়ে এসে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুই বড় জোটের বাইরে থাকা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা প্রশ্নে বিএনপিকে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে ছাড় দিতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়া চৌধুরী ও মোহাম্মদ নাসিম মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো অবকাশই নেই। একইভাবে মহাজোট সরকারের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেছেন, জামায়াত-শিবির যে নৈরাজ্য চালাচ্ছে, দেশজুড়ে প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমেই তা মোকাবিলা করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় এ পর্যন্ত সাত পুলিশসহ প্রায় ৮০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সর্বশেষ যোগ হয়েছে শনিবার মধ্যরাতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ ইমতিয়াজকে হত্যার ঘটনা। এর আগে নারায়ণগঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়কের ছেলে তানভীর ত্বকী হত্যাকাণ্ড, সিলেটের জগৎজ্যোতি, ব্লগার রাজীবসহ কয়েকজন মেধাবী ছেলে হত্যার শিকার হয়েছে। এর আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার সাক্ষী। এ কয়েক দিনে জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হয়েছে সোয়া ২০০ কোটির টাকার বেশি। সাধারণ মানুষসহ বেসরকারি ক্ষতির হিসাব এর বাইরে।
এ পরিস্থিতিতে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানিয়ে সরকার ও বিরোধী দলকে এই মুহূর্তেই আলোচনায় বসার পরামর্শ দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক এ আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। দেশের সাধারণ মানুষও এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া_এই দুই নেত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দল কেউ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে রাজি নয়। সংলাপের পক্ষে কোনো কোনো নেতা বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেও বাস্তবে কোনো উদ্যোগ নেই। বিএনপি যেমন সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও আপস না করার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দুই জোটের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলেও ক্ষমতাসীন জোট নির্বিকার।
তবে সাধারণ মানুষের এ মুহূর্তের বক্তব্য হচ্ছে, রাজনীতির জন্য কারোর জানমালের নিরাপত্তা বিঘি্নত হতে পারে না। তারা বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চললেও তা কখনো সহিংস রূপ নেয়নি। কিন্তু হত্যা, সন্ত্রাস-সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, পুলিশের ওপর হামলা করে হত্যা করা, একের পর এক হরতাল ডাকা শুরু হয় তখনই যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় দেওয়া শুরু হয়। তাই সাধারণ মানুষের দাবি হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসে সবার জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা আরো বলছে, দিনের পর দিন হরতাল দিয়ে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনারও ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে।
এদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠছে যে আন্দোলনটিকে আওয়ামীকরণ করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করে লাখো মানুষ অহিংস এ আন্দোলনে যোগ দেয়। আওয়ামীকরণের অভিযোগ জোরালো হওয়ায় বহু মানুষ গণজাগরণ মঞ্চকে আর ভরসাস্থল ভাবতে পারছে না।
দুই বড় জোটের বাইরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এ দলের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও মনে করেন দেশে এখন চরম সংকট চলছে। কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিএনপিকে ছাড় দিতে হবে। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে ছাড় দিতে হবে। এ লক্ষ্যে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সিপিবির এই নেতা বলেন, ‘ইস্যু দুটো। কিন্তু একটিকে আরেকটির সঙ্গে মেলানো যাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রশ্নটি আমার রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এখানে সব গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সংগঠনকে এক হতে হবে। জামায়াতকে বিএনপির তালাক দিতে হবে। আর নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি কী হবে তা নির্বাচনের আগেই ফয়সালা হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ কী পদ্ধতির সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে ছাড় দিতে হবে। তাহলেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।’
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার মনে করেন, সংকট দূর করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং আলোচনা বা সংলাপের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরো স্পষ্ট করারও দাবি জানান তিনি। এম কে আনোয়ার বলেন, বিএনপি বিগত দুই বছর ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আন্দোলন করে আসছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে নয় বিএনপিও। তবে সে বিচার স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকমানের হতে হবে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে জামায়াত ছেড়ে বিএনপি বেরিয়ে আসবে কি না জানতে তাইলে এম কে আনোয়ার স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করার প্রশ্নে তিনি একাত্ম থাকার পক্ষেই মত ব্যক্ত করেন; এই বলে যুক্তি দেখান যে জামায়াত তাঁদের জোটের পুরনো শরিক দল।
ক্ষমতাসীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মনে করেন, বর্তমানে যে সংকট চলছে তার সমাধান দেশবাসীই বের করেন। তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ একাত্তর সালের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পেরেছে, এবারও পারবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে এটি মোকাবিলা করা হবে। এ লক্ষ্যে সারা দেশে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রশ্নে তিনি দুই পক্ষের এক টেবিলে বসাকে সমর্থন করেন। মেনন বলেন, সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টিতে ঐকমত্যে পেঁৗছতে হবে।
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী মনে করেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না_বিএনপির এ দাবি সরকার পূরণ করতে পারবে না। কারণ এটা জনগণের দাবি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিও মৃত। এর কোনোটির সঙ্গে সরকার কারো কাছে আপস করবে না।’
প্রায় একই ধরনের অবস্থান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের। তিনিও মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু কোনোটিতেই ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মোহাম্মদ নাসিম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের জাগরণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আজ জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ দাবির ক্ষেত্রে কোনো অপশক্তির সঙ্গে সরকার আপস করতে পারে না। সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী সরকার। বিএনপির অপর দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এটাও আদালতের নির্দেশনায় বাতিল করা হয়েছে। কোনো আন্দোলনের মুখে এটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন না দুই নেত্রী সংলাপে বসলেই সমাধান আসবে। তাঁর মতে, সমাধানসূত্র আছে নির্বাচনের ফর্মুলায়, আর কিছুতে না। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ সংকটকে আরো ঘনীভূত করতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের আর সাত/আট মাস বাকি। এখন প্রয়োজন নির্বাচনের ফর্মুলা ঠিক করা। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ এ ব্যাপারে সব দল একমত নয়। সব দল বিশেষ করে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে হলে ফর্মুলা স্পষ্ট করতে হবে। এ কাজে সরকার যত দেরি করবে, সংঘাত ততই বাড়বে বলেও তিনি সতর্ক করে দেন।
দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে বিভিন্ন মহলের আহ্বান প্রসঙ্গে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই নেত্রী বা প্রধান দুই দলের প্রধানরা সংলাপে বসলেই সমাধান আসবে না। আগে নির্বাচনের ফর্মুলা দিতে হবে। দুটি বা তিনটি ফর্মুলা থাকলে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ সংবিধান সংশোধনেরও প্রয়োজন হতে পারে। আর আগে ফর্মুলা ঘোষণা করা প্রয়োজন।’
Leave a Reply