গত মাসে করাচি সাহিত্য উৎসবে উপস্থাপিত অনেকগুলো বইয়ের মধ্যে একটির শিরোনাম দেখা গেলো ‘মুসলিমস্ ইন ইন্ডিয়ান সিটিজ’। এগারটি রচনার সংকলন বইটি। লেখাগুলোর বিষয়বস্ত্ত কেমন চলছে ভারতের বিভিন্ন শহরের বাসিন্দা মুসলমানদের জীবনযাত্রা। মুসলিম বঞ্চনার ব্যাখ্যান হলো বইটির সাব-টাইটেল। লরেন্ট গেয়ার ও ক্রিস্টোল জ্যাফ্রেলট সংকলিত বইটি তুলে ধরেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়দের তুলনায় পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগণের জীবনযাত্রার অপ্রকাশিত কষ্ট ও দুর্দশা ভোগের বহু করম্নন কাহিনী। সাচার কমিটি উদ্ঘাটিত বহু কটু বাসত্মবতা বইটিতে স্থান পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের শাসনাধীন ভারতীয় মুসলমানদের দুরবস্থা যাচাই করে দেখার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল সাচার কমিটি। দেখা যায়, অন্য সমসত্ম শহরবাসীর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চাকরিতে অংশগ্রহণ যেখানে ২১ শতাংশ মুসলমান সেখানে রয়েছেন মাত্র ৮ শতাংশে। দারিদ্র্য রেখার নিচে জীবনযাপন করেন ৩১ শতাংশ মুসলিম। ৩৫ শতাংশে রয়েছেন দলিত ও আদিবাসীরা। এদেরই আশপাশে রয়েছে মুসলমানের জীবনমান। রোজগার ক্রমেই কমে যাচ্ছে মুসলমানদের।
ভারতের মুসলমানরা ছিলেন মূলত শহরের বাসিন্দা। সুলতানী আমল থেকে শুরম্ন করে মোগল শাসন পর্যমত্ম ক্রমপ্রসারমান সুদৃশ্য শহরগুলোতেই মুসলমানরা নির্বাসিত থেকেছেন। গ্রামীণ এলাকায় জায়গীরের অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু জায়গীর পরিচালনার প্রয়োজনে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে নিবাস গড়তে যাননি শহরের মুসলিম অভিজাতজনেরা। জায়গীর দেখাশোনার কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতেন অভিজাতদের অধীনস্থ বিভিন্ন সত্মরের কর্মচারীরা। শহরপ্রিয় এই অভিজাত সামমত্মদের নির্বিকার আত্মমগ্ন জীবনযাত্রার কাহিনী সত্যজিত রায় তুলে ধরেছেন তার ‘শতরঞ্জ কে কিলাড়ি চলচ্চিত্রে।
১৮৫৭-এর রক্তÿয়ী বিপস্নবের পরবর্তীতে ভারতীয় মুসলিম সম্ভ্রামত্ম সম্প্রদায়ের পতন ও বিপর্যয়ের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন উইলিয়ম ডালরিম্পল তার লাস্ট মোগল বইয়ে।
১৮৫৭ বিদ্রোহের নেতৃত্ব সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর দিয়েছিলেন সত্য। কিন্তু স্বেচ্ছায় নয়। তা সত্ত্বেও বাহাদুর শাহের ভূমিকার খুব সরল ব্যাখ্যা খাড়া করে বিদ্রোহের পরবর্তীতে বৃটিশ শাসক সম্প্রদায় প্রচ- প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে এলো ভারতের সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে দোষী ঠাঁউরিয়ে তাদের শায়েসত্মা করার উদ্দেশ্যে। দিলস্নীর সমসত্ম মুসলিম এলাকা গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। ফাঁসি দেয়া হলো হাজার হাজার মুসলমানকে। গুলী চালিয়ে ও তোপের মুখে উড়িয়ে দেয়া হলো হাজারও মুসলিমকে। বাহাদুর শাহসহ অন্য অনেককে নির্বাসনে পাঠানো হলো ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করার জন্য।
অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রচ- আঘাতে অমত্মর্মুখী ভাবনায় আলোড়িত হলো মুসলিম মানস। সহায়সম্বলহীন অবশিষ্ট মুসলিম জনগণ জীবন রক্ষার তাড়নায় বৃটিশ কর্তৃপÿÿর অধীনে চাকরির সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে গিয়ে লক্ষ করলেন, দেশ জুড়ে প্রবর্তিত পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষা প্রণালীতে তাদের স্থান শূন্য। শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। গড়লেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু মুসলিম জনমানসের একাংশে তখনও বহাল রইলো। পরদেশী দখলদার বৃটিশদের প্রতি অসহিষ্ণু বৈরী মনোভাব। পাশাপাশি অনেকেই কিন্তু স্থির করলেন অতীতকে পেছনে রেখে তাদের ওপর চেপে বসা বৃটিশদের অধীনে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টায় এগিয়ে যাওয়াই হবে উত্তম কাজ। কারণ অন্য কোনো পথ সামনে আর খোলা নেই। হিন্দুরা ততোদিনে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। দেশ শাসনের অধিকার হারানোর বা পদমর্যাদা হারানোর কোনো অনুশোচনা বা পিছুটানে হিন্দুদের তখন ভুগতে হয়নি। শাসনতন্ত্রে ও অন্যত্র বহু উঁচু পদে ততোদিনে অধিষ্ঠিত হয়ে গেছিল হিন্দুরা। অবশ্যই উলেস্নখ্য বৃটিশের হাতে মুসলিম শাসন সমাপ্তিকে ভাগবানের আশীর্বাদ বলে বরণ করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়।
নিজেদের সম্প্রদায়ের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেওবন্দের ইসলামী তত্ত্ববিদেরা শাসন ব্যবস্থায় ও জীবনযাপনে মোগল শাসকদের হিন্দু প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়াতেই বড় ধরনের দোষ আবিষ্কার করলেন। তাদের প্রচারের মূলীভূত বক্তব্য রইলো- ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের আদি ও অকৃত্রিম ধর্মবিশ্বাস ও অনুশীলনে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যমত্ম হারানো গৌরব পুনরম্নদ্ধার মুসলমানের পক্ষ সম্ভব হবে না। ডারলিম্পল মনে করেন ১৮৫৭ পরবর্তীতে মুসলিম মানসে রোপিত স্বকীয়তামাত্র এই বিশিষ্ট ইসলামী বিশেস্নষণ ও চেতনার মধ্যেই নিহিত ছিল পরবর্তী ভারত বিভাজনের বীজ।
বহু সংখ্যক মুসলিম পরবর্তীতে বৃটিশ রাজ প্রবর্তিত পশ্চিমা বিদ্যাচর্চায় এগিয়ে এলেন বটে। কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম ইসলামে ফিরে যাওয়ার বাসনা বিপুল সংখ্যক মুসলিম মানসে তখনো বহাল রইলো। তারা ছেলেদের স্কুলে না দিয়ে মাদরাসায় পাঠালেন। মেয়েদের পড়াশোনার আয়োজন করলেন বাইরে না পাঠিয়ে ঘরের মধ্যে। অন্যদিকে শিক্ষায়, চাকরিতে বৃটিশ প্রবর্তিত যাবতীয় আয়োজনে ভাগ বসিয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে লাগলো হিন্দুরা।
ভারত ভাগ হলে মুসলিম নেতৃত্বের ও দক্ষ পেশাজীবীদের বৃহদংশটি পাড়ি জমালো নবসৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিসত্মানে। ভারতে রয়ে গেলেন বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনগণ। শিক্ষায় অনগ্রসর তারা ছিলেন আগে থেকেই। এবার তারা ভুগতে শুরম্ন করলেন হতাশায় ও দিশাহীনতায়। আনুগত্য নিবেদনের ক্ষেত্রে খুঁজতে তারা হয়ে পড়লেন দ্বিধাগ্রসত্ম ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতীয় মুসলমানদের দুর্দশা চূড়ামেত্ম পৌঁছালো। শিক্ষা ও জীবিকার সংস্থান বঞ্চিত মুসলমানরা বাঁচার গরজে উষ্ণবৃত্তি অবলম্বনে আশ্রয় গড়লেন শহর থেকে দূরে অন্য কোথাও জনযোগাযোগবিহীন বসিত্মর ঝুপড়িজীবনে। মুসলমানদের লেখাপড়া লাটে ওঠে। মনুষত্যের জীবনযাপন হয়ে দাঁড়ায় গরিষ্ঠসংখ্যক ভারতীয় মুসলমানের ভাগ্যলিপি। ২০১১ সালের আদমশুমারির ফল ভারত এখনো প্রকাশ করেনি। অনেকে সন্দেহ করছেন, বিলম্বের কারণ হচ্ছে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রম্নতগতিতে বেড়ে চলার খবর সরকার জনসমক্ষে আনতে অনিচ্ছুক। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির খবর প্রচারের পাশাপাশি মুসলিম বেকারত্ব ও মুসলিম দুর্দশা বৃদ্ধির খবরও মেনে নিতে ভারত সরকারকে বাধ্য থাকতে হবে। তাছাড়া সব মিলিয়ে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গড়পরতা কমে এলেও মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাসের হার হিন্দু বা অন্যান্য জনসংখ্যার তুলনায় অনেকখানি কম। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনমন এ খবরের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ ও আলোড়িত হতে বাধ্য। বেসরকারী পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে ইকোনোমিস্ট বলেছে ভারতের মুসলিম জনসংখা বর্তমানে এসে পৌঁছেছে ১৭ কোটি ৭০ লাখে। অর্থাৎ ভারতের মোট জনসংখ্যার মুসলমানরা হচ্ছেন ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বাবরি মসজিদ, গুজরাত ও বোম্বে হামলা কেন্দ্রিক মুসলিম হত্যা অভিযানে সূচিত হিন্দু-মুসলিম অবিশ্বাস ও মুসলিম মনে সৃষ্ট আতঙ্কবোধকে স্মরণে রেখে সমকালীন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কচিত্রকে অনেকে আগের তুলনায় অনেকখানি সহনীয বর্ণনা করলেও ইকোনোমিস্টের প্রশ্নের জবাবে দিলস্নীস্থিত ‘‘কমিশন ফর মাইনরিটিজ’’য়ের প্রধান ওয়াজাহাত হাবিবুলস্নাহ বলেন, মুসলমানরা আগের তুলনায় ভালো অবস্থায় রয়েছেন, এমন সুখকর বোধোদয়ের কোনো কারণ তিনি দেখছেন না। তিনি বোঝাতে চান, ভারতের মুসলমানদের ভীষণ দুর্দশাক্লিষ্ট জীবন আগের মতোই আজো বহাল রয়েছে। উন্নয়নের ধারায় মুসলমানদের আনুপাতিক হারে আজো শামিল হতে দেয়া হচ্ছে না।
Leave a Reply