আমেরিকা ইউরোপজুড়ে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা, সন্ত্রাসে অর্থায়ন আর মানিলন্ডারিংয়ে সহায়তার অভিযোগে ভয়াবহ সংকটের কবলে পড়েছে বিশ্বখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি। আর বিশ্ব মন্দা আর ইমেজ সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি)।
উল্লেখ্য গত বছর জুলাইয়ে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে অর্থের অবৈধ লেনদেন ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ ওঠে। বড় অংকের জরিমানা দিয়ে শেষ রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে এইচএসবিসি। এ ঘটনার পর থেকে বিশ্বব্যাপি চরম আস্থার সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। সেই সাথে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ায় কার্যক্রম অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে আর সংকটে পড়ে যায় ব্যাংকটি।
এইচএসবিসির অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র মতে, সংকটের কারণে তারা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে তাদের বাজার নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে না। তবে এখান থেকে গুটিয়ে নিয়ে ব্যাংকটি ভিন্নরকম অজুহাত সামনে নিয়ে আসছে। তারা বলতে চাইছে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সংকটে পড়বে। এ নিয়ে তারা একটি গবেষণা করেছে। এসব বিবেচনা করে তারা মূলত এদেশ থেকে চলে যেতে চাইছে।
উক্ত সূত্রমতে, সম্প্রতি বাংলাদেশে আরো বেশ কটি নতুন ব্যাংক অনুমোদন পাওয়ায় ব্যাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বেশ প্রতিযোগিতা মূলক এবং সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। তার ওপর বিদেশি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় এইচএসবিসি এখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না আগে থেকেই। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সরে যেতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সৌদি আরবের আল রাজি ব্যাংক ও বাংলাদেশের দুটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন পরিচালনার পথ করে দিয়েছে এইচএসবিসি। এইচএসবিসির যুক্তরাষ্ট্র শাখা এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এইচএসবিসির ২৪টি শাখায় বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের হিসাব আছে। ২০০০ সালে ওই ব্যাংকটির জন্য এই হিসাব খোলার অনুমতি চাওয়ার পরপরই অর্থের অবৈধ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্ন উঠে। এনিয়ে মার্কিন সিনেটে ব্যাপক নিন্দা শুরুর পর ২৬ জুলাই মেক্সিকো ব্যাংকির বিরুদ্ধে জরিমানা করে। বাংলাদেশের দুটি ব্যাংক মেক্সিকোর মাদক ব্যবসার অবৈধ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবাজারে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ পায়। ঘটনা অনুসন্ধানে গঠিত মার্কিন সিনেটের একটি উপকমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে এমন একটি প্রতিবেদন দেয়। এরপর শুনানি শেষে এর সত্যতা নিশ্চিত হয়। যার জন্য দায়িত্ব থেকে সড়ে দাড়ান এর তৎকালীন প্রধান নির্বাহী। মানিলন্ডারিংবিরোধী আইন পালনে শৈথিল্য দেখানোর অভিযোগে ইউরোপের বৃহত্তম ব্যাংক এইচএসবিসিকে ২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার জরিমানা করে মেক্সিকো। অন্যদিকে অর্থপাচারে সহায়তা করার আরেকটি অভিযোগে ব্রিটিশ এইচএসবিসি ব্যাংক পিএলসি ১৮০ কোটি ডলার জরিমানা করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাংলাদেশে থেকে সরে গেলেও এইচএসবিসি রিটেইল ব্যাংকিং কার্যক্রম আরেকটি বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড-এর কাছে বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অনেক আমদানি-রফতানিকারক সরাসরি বহুজাতিক এ ব্যাংকটির সঙ্গে জড়িত। এইচএসবিসির অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিছক গুজব বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাবসা সরিয়ে নেওয়ার কোন সম্ভবনা আপাতত আমাদের নেই। বাংলাদেশের অনেক আমদানি রফতানিকারক আমাদের সাথে ব্যাবসা করছে। তিনি বলে, সংকটে পড়ার মতো কোনো অবস্থা এখন পর্যন্ত হয়নি। আর ইচ্ছে করলেই কোনো ব্যাংক তার কার্যক্রম এতো সহজে বন্ধ করতে পারে না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, এইচএসবিসির বাংলাদেশ থেকে ব্যাবসা গুটিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। তারা এ বিষয়ে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কিছুই জানায়নি। কোনো বিদেশি ব্যাংক এদেশ থেকে ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে হলে কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। ২০১২ সালের ১৭ জুলাই সন্ত্রাসে অর্থায়নের অপরাধের সঙ্গে বাংলাদেশের দুটি ব্যাংকের সাথে এইচএসবিসির সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে প্রথম শাখা খোলে এইচএসবিসি। এখন বাংলাদেশে মোট ১৩টি শাখা রয়েছে। এছাড়া প্রায় অর্ধশত বুথ রয়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ব্যাংকটির ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে।
Leave a Reply