শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:২৬

আজ ভয়াল সেই ২৫ মার্চ

আজ ভয়াল সেই ২৫ মার্চ

 

 

 

 

 

 

 

 

কালের পরিক্রমায় আবার এসেছে সেই ভয়াল ২৫ মার্চ। আজকের এদিনে বাঙ্গালী জাতির সামনে নেমে এসেছিলে এক প্রলোয়ণকারী মহা দুর্যোগ। সেদিন কী ঘটেছিল এ প্রজন্মের অনেকের কাছে তা আজো অজানা। নতুন প্রজন্মের অনেকই আবার বিভ্রান্তিমুলক কাহিনী শুনে দ্বিধাগ্রস্থ আছেন। আসলে কি ঘটেছিল ২৫ মার্চে সেই দিনে বাংলার মাটিতে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নৃশংস অভিযান চালায় তা ইতিহাসে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। ঘরে ঘরে তল্লাশি বা সার্চ করার লক্ষ্য নিয়ে এ অপারেশন চালানো হয় বলে তাকে অপারেশন সার্চলাইট হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশে একটি বিশেষ বিমানে আরোহনের আগে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল রাজা টিক্কা খানকে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, যে কোন পন্থাই হোক তাদের শায়েস্তা করো। এটাই ছিল অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করার নির্দেশ। অপারেশন শুরু হওয়ার পর পরই শুরু হয় প্রতিরোধ লড়াই। ২৫ মার্চ রাত ছিল ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের শেষ দিন।

জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান হোটেল শেরাটন) এগারো তলায় অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে তিনি অপারেশনের তান্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় তাকে জাগানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি রাতে বিভোর ঘুম দেন। তার স্যুটের প্রবেশ পথে ছিল দু’জন সশস্ত্র প্রহরী। ২৬ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। করাচি বিমান বন্দরে অবতরণ করে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।’
কারফিউ জারি করে সামরিক অপারেশন চালানো হয়। ২৭ মার্চ সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত দু’ঘণ্টা এবং ২৮ মার্চ আবার চার ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। কারফিউ শিথিল করা হলে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে অজানার উদ্দেশে স্রোতের মতো মানুষ বের হয়ে যায়। কেউ আশ্রয় নেয় গ্রামে ফেলে আসা পৈত্রিক বাড়িতে। নয়তো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে। কোথাও ঠাঁই না পেয়ে বহু লোক সীমান্ত পাড়ি দেয়। ছিন্নমূল লাখ লাখ মানুষকে প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী হিসাবে ৯ মাস কাটাতে হয়েছে। দেশান্তরিত হয়ে অনেকেই নিজ মাটির জন্য আহাজারি করেন মহান আল্লাহর কাছে। আবার অনেকেই মাটির মায়ায় থেকে যান নিজ দেশে। বন্ধুক চালানোর কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও হাতে তুলে নেন বন্দুক নিজ দেশের জন্য, দেশের আপামর জনগনের জন্য, নিজ দেশে নিজ মাটিতে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য, বাংলাদেশ নামক দেশটিকে প্রতিষ্টার জন্য।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং চতুর্দশ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্টাফ মিটিংয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ বৈঠকের সিদ্ধান্তক্রমে কোয়েটায় মোতায়েন ষোড়শ এবং খারিয়ানে মোতায়েন নবম ডিভিশনকে পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।

এ পরিকল্পনা কার্যকর করার আগে বেসামরিক লোকজনের উপর সামরিক অভিযানের বিরোধিতাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। যাদের অব্যাহতি দেয়া হয় তাদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান। লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৭ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সি-ইন-সি জেনারেল আবদুল হামিদ খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে পরিকল্পনা প্রণয়নের কর্তৃত্ব প্রদান করেন। ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জিওসির কার্যালয়ে জেনারেল রাজা ও জেনারেল ফরমান এ পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেন। জেনারেল ফরমান হাল্কা নীল অফিস প্যাডে স্কুলের সাধারণ কাঠ কলম দিয়ে এ পরিকল্পনা লিখেন। পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী পরিকল্পনায় ১৬ টি অনুচ্ছেদ ছিল।

জেনারেল ফরমান অপারেশনের কৌশলগত ও সফলতার শর্তগুলো ব্যাখ্যা করেন। অন্যদিকে জেনারেল খাদিম বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটে সৈন্য প্রেরণ এবং তাদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টনে পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ প্রণয়ন করেন। ধারণা করা হয়েছিল যে, অপারেশন শুরু হলে বাঙালি সৈন্য ও অন্যান্য আধাসামরিক ইউনিট বিদ্রোহ করবে। এ আশংকা থেকে পরিকল্পনাকারীরা সকল সশস্ত্র বাঙালি ইউনিটকে নিরস্ত্র করার এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরিকল্পিত একটি বৈঠকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গ্রেফতারের সুপারিশ করেন। ২০ মার্চ বিকালে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে জেনারেল হামিদ ও লে. জেনারেল টিক্কা খান হাতে লেখা এ পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেন।

জেনারেল হামিদ তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্রীকরণের অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিয়ে বলেন, তা কার্যকর করা হলে বিশ্বের একটি উৎকৃষ্টতম বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে তিনি ইপিআর, সশস্ত্র পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীকে নিরস্ত্র করার সুপারিশ অনুমোদন করেন। বিভিন্ন দায়িত্বে সৈন্য বন্টনের পর কোনো রিজার্ভ সৈন্য থাকবে কিনা জানতে চাইলে জিওসি তৎক্ষণাৎ জেনারেল আবদুল হামিদকে নাসূচক জবাব দেন। ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে বৈঠকরত অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের সুপারিশে অনুমোদনদানে অস্বীকৃতি জানান।

এ সংশোধিত পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয় এবং বিভিন্ন এলাকায় কমান্ডারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মেজর জেনারেল ফরমান ঢাকা অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। প্রদেশের বাদবাকি অংশে নেতৃত্ব দেন খাদিম হোসেন রাজা। লে. জেনারেল টিক্কা খান ও তার স্টাফ চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ড স্টাফের তত্ত্বাবধান এবং তাদের সহায়তাদানে ৩১তম ফিল্ড কমান্ড সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন।

রাত সাড়ে ১১টায় প্রথম ওয়ারলেস সেট সজ্জিত জীপগুলোতে স্টার্ট দেয়া হয়। প্রতিপক্ষ প্রতিরোধের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে থাকায় ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার ‘এইচ আওয়ার’ এগিয়ে আনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। সবাই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ছিলেন তখন কলম্বো ও করাচির মধ্যবর্তী আকাশে। জেনারেল টিক্কা তার নির্দেশে বলেন, ‘ববিকে’ (ব্রিগেডিয়ার আরবাব) অভিযান চালাতে বলো।’ পরিকল্পনায় ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ব্রিগেডকে নিন্মোক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়:

১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রিজার্ভ হিসাবে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করবে এবং প্রয়োজনবোধে ঢাকা সেনানিবাস রক্ষা করবে। ৪৩তম হাল্কা বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট বিমান বন্দর এলাকার উপর নজর রখাবে। ২২তম বালুচ পিলখানায় ইপিআরের আনুমানিক ৫ হাজার সদস্যকে নিরস্ত্র করবে এবং তাদের ওয়ারলেস এঙচেঞ্জ দখল করবে। ৩২তম পাঞ্জাব রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ‘অতিমাত্রায় মটিভেটেড’ এক হাজার পুলিশ সদস্যকে নিরস্ত্র করবে। ১৮তম পাঞ্জাব নবাবপুর ও হিন্দু অধ্যুষিত পুরনো ঢাকায় ছড়িয়ে পড়বে। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট সেকেন্ড ক্যাপিটাল এবং মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বিহারী বসতি নিয়ন্ত্রণ করবে। ১৮তম পাঞ্জাব, ২২তম বালুচ ও ৩২তম পাঞ্জাব থেকে একটি করে কোম্পানি নিয়ে গঠিত একটি মিশ্র বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল এলাকা মুক্ত করবে। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (কমান্ডো) একটি প্লাটুন মুজিবের বাসভবনে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করবে। ভোরের আলো ফোটার আগে শক্তিপ্রদর্শনে এম-২৪ ট্যাংকের একটি বহর বের হবে। এসব সৈন্য তাদের নিজ নিজ এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে, সম্ভাব্য প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেবে এবং তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক নেতৃৃবৃন্দকে তাদের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করবে। রাত ১টার আগে সৈন্যরা তাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবে। তবে কয়েকটি ইউনিট পথে বিলম্ব হওয়ার আশংকায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশন, টেলিফোন এঙচেঞ্জ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যরা এইচ আওয়ারের আগে তাদের অবস্থান গ্রহণ করে।

এ অপারেশনের সময়সীমা ছিল ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত। অপারেশন সার্চলাইটের পরবর্তী কোনো কর্মসূচি না থাকায় এ পরিকল্পনা ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চের আগে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডিভিশন ছিল মাত্র একটি। ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও চার সপ্তাহের মধ্যে বিমানযোগে পাকিস্তানের নবম ও ষোড়শ ডিভিশনকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতীয় এয়ারলাইন্সের ফকার ফ্রেন্ডশীপ বিমান ‘গঙ্গা’ ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে গিয়ে উড়িয়ে দেয়া ছিল পাকিস্তানকে ফাঁদে ফেলার একটি ভারতীয় কৌশল। দু’জন ভারতীয় এজেন্ট নিজেদেরকে ‘কাশ্মীরী মুজাহিদ’ পরিচয় দিয়ে বিমানটি ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে যায়। কথিত মুজাহিদরা ছিনতাইকৃত ভারতীয় বিমান উড়িয়ে দেয়ায় পাকিস্তান উল্লসিত হয়। ভারত এমনটাই প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু পাকিস্তান জানতো না যে, ‘কাশ্মীরী মুজাহিদ’ হিসাবে পরিচয়দানকারী বাট ও হাশিম কোরেশী প্রকৃতপক্ষে ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। বাট নিজের পরিচয় গোপন করে বিএসএফ’র সদস্য হিসাবে কাজ করতো। ‘গঙ্গা’ ছিল একটি পুরনো বিমান। বিমানটি সার্ভিস থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পিত ছিনতাইয়ের কয়েকদিন আগে বিমানটিকে সার্ভিসে নিয়োগ করা হয়। এ পরিত্যক্ত বিমান উড়িয়ে দেয়ার অজুহাতে ভারত তার আকাশসীমার উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে। ভারতের উপর দিয়ে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় কার্যত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ২৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল নাগাদ ‘অপারেশন গ্রেট ফ্লাই-ইন’ সাংকেতিক নামে পিআইএ’র বোয়িং বিমান যোগে শ্রীলংকার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নবম ও ষোড়শ ডিভিশনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ এ অপারেশনের লক্ষ্য ছিল না। মূলত রাজধানী ঢাকা ছিল অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু। বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকায় অপারেশন শুরু হয়। ঢাকার বাইরে ৩০ মার্চ নাগাদ বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের সংঘর্ষ শুরু হয়নি। ঢাকায় অবস্থানকারী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সৈন্যদের লক্ষ্য ছিল নিম্নোক্ত:

(১) রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা এবং টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও রেডিও স্টেশন বিচ্ছিন্ন এবং সকল প্রচার মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া। (২) রাজপথ, রেলপথ ও নদী যোগাযোগ দখল করে রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে ফেলা। (৩) শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ ১৫ জন নেতাকে গ্রেফতার করা। (৪) ধানমন্ডি ও হিন্দু এলাকায় ঘরে ঘরে তল্লাশি করা। (৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় ইপিআর সদরদপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন দখল করা এবং দ্বিতীয় ও দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা। (৬) রাজেন্দ্রপুর গোলাবারুদ তৈরির কারখানা এবং গাজীপুর অস্ত্রাগার দখল করা। ইস্টার্ন কমান্ডের সদরদপ্তর ছাড়াও চতুর্দশ ডিভিশন ও ৫৭ ব্রিগেডের সদরদপ্তর ছিল ঢাকা সেনানিবাসে। যেসব পাকিস্তানি সেনা ইউনিট ঢাকায় অবস্থান করছিল সেগুলো হলো ৫৭তম ব্রিগেড, ১৮তম ও ২২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ত্রয়োদশ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্ট। চতুর্দশ ডিভিশনের সঙ্গে ছিল ৪৩তম লাইট আক আক রেজিমেন্ট (বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট), তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, ১৯তম সিগনাল রেজিমেন্ট ও ১৪৯তম পদাতিক ওয়ার্কশপ। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সৈন্যরাও ঢাকায় অবস্থান করছিল। ২৯তম ক্যাভালরি রেজিমেন্টের ১৪টি এম-২৪ শ্যাফি ট্যাংক ঢাকায় নিয়োজিত ছিল। অতি গোপনীয়তার সঙ্গে এ অপারেশন চালানো হয়। মুষ্টিমেয় লে. কর্নেল পূর্বাহ্নে অপারেশন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে ৬টি বাঙালি পদাতিক রেজিমেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছিল। ১০৭ ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত প্রথম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ছিল যশোরে। ৫৭ ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে। ২৩ ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ছিল সৈয়দপুরে। ৫৩তম ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত চতুর্থ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ছিল কুমিল্লায়। চট্টগ্রামে অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) দুই হাজার বাঙালি সৈন্য ছিল। এ রেজিমেন্টের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল নবগঠিত নবম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট। চতুর্দশ ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম, দ্বিতীয় ও দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন বাঙালি। বাদবাকি রেজিমেন্টগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের কমান্ডে। অপারেশনের সফলতা নিশ্চিত করতে বাঙালি অফিসারদের স্পর্শকাতর এলাকা থেকে বদলি করা হয় এবং তাদের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হয়।

শীতকালীন প্রশিক্ষণের নামে প্রথম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে যশোর থেকে সরিয়ে সীমান্তের কাছে চৌগাছায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তারা ২৯ মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করে। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কোম্পানিগুলোকে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয় এবং তাদের রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। চতুর্থ ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শমসেরনগরের মাঝামাঝি মোতায়েন করা হয়। কেবলমাত্র চট্টগ্রামে বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নিজেদের শিবিরে অবস্থান করার অনুমতি দেয়া হয়। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী দশম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন বাঙালি লে.কর্নেল ময়েনউদ্দিন। ঢাকার পিলখানায় ইপিআর সদরদপ্তরে আড়াই হাজার ইপিআর সদস্য অবস্থান করছিল। প্রত্যেক ইপিআর উইংয়ে ছিল ৩টি করে কোম্পানি। দুই কোম্পানি ইপিআর মোতায়েন করা হয় মিরপুরে, আরো দুই কোম্পানি মোতায়েন করা হয় প্রেসিডেন্ট হাউসে এবং অন্য একটি কোম্পানি মোতায়েন করা হয় গভর্নর হাউসে। ইপিআরের মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কমপক্ষে দুই হাজার সশস্ত্র পুলিশ অবস্থান করছিল। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন বাঙালি লে. কর্নেল রকিব। এ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ছিল টাঙ্গাইলে এবং আরেকটি ময়মনসিংহে। গাজীপুরেও কিছু বাঙালি সৈন্য ছিল। তৃতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের সদরদপ্তর ছিল সৈয়দপুরে। এ রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য অবস্থান করছিল ঘোড়াঘাটে এবং এক কোম্পানি অবস্থান করছিল পার্বতীপুরে। ইপিআরের তিনটি উইংয়ের নবম উইং অবস্থান করছিল ঠাকুরগাঁয়ে, অষ্টম উইং ও সেক্টর সদরদপ্তর দিনাজপুরে এবং দশম উইং রংপুরে। ইপিআরের প্রতিটি উইংয়ে ছিল ৪টি পদাতিক কোম্পানি। তাদের গোলাবারুদ মজুদে মর্টার ও ট্যাংকবিধ্বংসী কামান ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি লে. কর্নেল তারিকুল আর. কোরেশী ছিলেন ইপিআরের সেক্টর কমান্ডার।

পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ‘এমভি সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাসে জনতা বাধা দেয়। বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার হোসেন জনতার উপর গুলিবর্ষণে অস্বীকৃতি জানালে ২৪ মার্চ তাকে কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার এমএইচ আনসারীকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ২২ মার্চ ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর, মেজর খালেদ মোশাররফকে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে (টু-আই-সি) কুমিল্লায় চতুর্থ বেঙলে বদলি করা হয়। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বাঙালি অফিসারদের ছুটি নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। যদিও ফেব্রুয়ারি থেকে সকল ছুটি বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের তাদের কর্মস্থলে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের পরিবারবর্গকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্থানান্তর করা হয়।

ক্র্যাকডাউনের আগে বাঙালি নিয়মিত সেনা ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্রীকরণে অনুমতি দানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান অস্বীকৃতি জানালে পাকিস্তানি সামরিক কমান্ড এসব ইউনিটের পক্ষ থেকে হুমকি হ্রাসে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। বাঙালি ইউনিটগুলোকে হয়তো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয় নয়তো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত করে ফেলা হয়। এসব ইউনিটকে দূরে পৃথক পৃৃথক অবস্থানে মোতায়েন করা হয়। ২৫ মার্চের আগে মূল রেডিও এবং ওয়ারলেস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল মেজর জেনারেল মিঠঠা খান ও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ অপারেশন সম্পর্কে গ্যারিসন কমান্ডার ও সিনিয়র পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের ব্যক্তিগতভাবে ব্রিফিংদানে ২৪ মার্চ হেলিকপ্টার যোগে বড় বড় গ্যারিসনগুলো সফর করেন। সৈন্যদের রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল আলী মীর্জা ও ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে পৌঁছান। গোলাবারুদের প্রধান মজুদ ছিল ঢাকার অদূরে রাজেন্দ্রপুরে। চট্টগ্রামে অপেক্ষমান ‘এমভি সোয়াত’-এ ছিল ৯ হাজার টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ। দ্রুত এ অস্ত্র খালাসের উদ্যোগ নেয়া হয়। পিআইএ ফ্লাইটে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা এসে পৌঁছতে থাকে। ফ্লাইটগুলোতে লেখা থাকতো ‘বিশেষ যাত্রী।’ এসব সৈন্য এসে পৌঁছানোর আগে ১৩তম এফএফ এবং ২২তম বালুচ ঢাকা এসে পৌঁছে যায়। ২৫তম পাঞ্জাব ও ২০তম বালুচের ঢাকা আগমন বিলম্বিত হয়। গোপনীয়তা রক্ষায় ২৫ মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানের সেনানিবাসগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে শক্তিবৃদ্ধি করা হয়নি। ২৪ অথবা ২৫ মার্চ রাতে ইপিআরের ওয়ারলেস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ২৫ মার্চ রাজধানী ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেছেন এবং আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা শহরে প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করছে। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা পাকিস্তানি সৈন্য চলাচলে তেমন উল্লেখযোগ্য বিলম্ব ঘটাতে পারেনি। ব্যারিকেড স্থাপনকারী স্বেচ্ছাসেবকদের উপর পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথম গুলিবর্ষণ করে। অপারেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল রাত ১১টায়। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় রাত সাড়ে ১১টায়। ঢাকায় লক্ষ্য অর্জনে সেনাবাহিনীকে ৬ ঘণ্টা সময় বেধে দেয়া হয়। ত্রয়োদশ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং অপারেশনকালে ৪৩তম হাল্কা আক আক বিমান বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। ঢাকা সেনানিবাসে দশম বেঙল রেজিমেন্টকে সহজে নিরস্ত্র করা হয় এবং পরে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। সেকেন্ড ক্যাপিটালে ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোতায়েন করা হয়। এ রেজিমেন্ট রাজধানীর উত্তরাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অপারেশন শুরু করার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজধানীর সকল যোগযোগ চ্যানেল বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি কমান্ডোরা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। রাত সাড়ে ১০টায় ২২তম বালুচ পিলখানায় ইপিআর সদরদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে এবং আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত ঠিক ১২টায় একটি গুলির শব্দ হয়। তারপরই ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানায় আক্রমণ শুরু করে। রাতব্যাপী প্রায় নিরস্ত্র ইপিআরের উপর হামলা চালায় এবং তাদের অসংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়। ২৬ মার্চ সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে বালুচ রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন ট্যাংকসহ এক নম্বর গেট দিয়ে গভর্নর হাউসে প্রবেশ করে। পাকিস্তানিরা ইপিআরকে ঘিরে ফেলে। গভর্নর হাউসে অবস্থানরত ইপিআরের উইং কমান্ডার মেজর জাহানজেব ও ক্যাপ্টেন জিলানি সবাইকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেন। ইপিআরের অনেকেই অস্ত্র জমাদানে অস্বীকৃতি জানায়। তারা ইশারায় সুবেদার রাজিবের কাছে আক্রমণ চালানোর জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি। এব্যাপারে সুবেদার রাজিব বলেন, ‘আমাদের যে অস্ত্র ছিল তা দিয়ে এক প্লাটুন বালুচ সৈন্য খতম করা যেতো। কিন্তু পরে আমরা একজনও বাঁচতে পারতাম না। আমাদের পিছু হটার পথ ছিল বন্ধ।’

গভর্নর হাউসের মতো প্রেসিডেন্ট হাউসেও হামলা চালানো হয়। প্রেসিডেন্ট হাউসে দুই কোম্পানি ইপিআর অবস্থান করছিল। তাদের সঙ্গে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্যও ছিল। তা সত্ত্বেও ২৫ মার্চ সন্ধ্যার দিকে ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী প্রেসিডেন্ট হাউসে জমায়েত হতে থাকে। সন্ধ্যার পর পরই ঢাকা সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আনোয়ার শাহ ইপিআরকে জানান, প্রেসিডেন্ট ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। একথা জানিয়ে তিনি অস্ত্র জমা দিয়ে সবাইকে বিশ্রাম গ্রহণের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে সবাই অস্ত্র জমা দেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সবাইকে বন্দি করে। বাঙালিদের বন্দি করার পর অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। ২৬ মার্চ ইপিআরের বাঙালি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আজাদসহ ২০ জওয়ানকে কন্ট্রোল রুম থেকে বন্দি করা হয় এবং বাদবাকিদের সঙ্গে তাদের আটক রাখা হয়। ২৯ মার্চ এক শো জনের মতো বাঙালি ইপিআর সদস্যকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদেরকে কালিবাড়ি মন্দিরের কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআরের দু’কোম্পানি সৈন্যের উপর পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ চালিয়ে অধিকাংশকে বন্দি করে। রমনা থানা এলাকায় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানিরা গোটা এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।

পিলখানার পাশাপাশি রাজারবাগ পুলিশ লাইনও আক্রান্ত হয়। রাত পৌনে ১০টায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে সৈন্য বোঝাই ৪০টি ট্রাক বিমান বন্দর সড়ক ধরে অগ্রসর হতে থাকে। তেজগাঁ পুলিশ কন্ট্রোল রুম এ সংবাদ রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে জানিয়ে দেয়। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ট্রাকগুলোর উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাদের একটি দল ফার্মগেট দিয়ে সেনানিবাসে ফিরে যাবার পথে রাত প্রায় ১১ টায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টিকারী জনতার উপর হঠাৎ করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমবারের মতো রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। পুলিশ বাহিনীর রাইফেলগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠলে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী ট্যাংক ও ভারি অস্ত্র নিয়ে বেপরোয়াভাবে আক্রমণ শুরু করে। ভোররাতের দিকে রাজারবাগ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অপারেশনকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে কামান ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভোর হওয়ার আগেই রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কারফিউ জারি করা হয়। ইপিআর ও পুলিশের জীবিত সদস্যরা পালিয়ে যায়। জিনজিরায় সংগঠিত হওয়ার জন্য কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেয়।

অষ্টাদশ ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে অবস্থানকারী নিরস্ত্র ছাত্র এবং শিক্ষকদের হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ রাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত একটি বিশেষ ভ্রাম্যমাণ বাহিনী স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক-বিধ্বংসী রাইফেল, রকেট লাঞ্চার, মর্টার এবং ভারি ও হাল্কা মেশিনগান সজ্জিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে। পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024