অন্ধ্র প্রদেশকে দুই টুকরো করে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত রুখে দিতে বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভা আক্ষরিক অর্থেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তেলেঙ্গানা রাজ্য নিয়ে আগের দিনের উত্তেজনা মারামারিতে গড়াল ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায়, যাতে পেপার স্প্রে ছিটানোর পাশাপাশি ছুরি প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটেছে।
হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়া এমপিরা বৃহস্পতিবার চেয়ার টেবিলও ভাংচুর করেছে বলে ভারতের সংবাদ মাধ্যমের খবের বলা হয়। যে কারণে ১৬ জন এমপিকে বহিষ্কার করেছেন স্পিকার মীরা কুমার। নজিরবিহীন এই হট্টগোলের মধ্যেই উপস্থাপন হয়েছে তেলেঙ্গানা বিল, যদিও উত্থাপনের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্দের কাছ থেকে বিলের কাগজ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাও হয়েছিল।
সাড়ে ১০টায় অধিবেশন বসার পর ১১টা পাঁচ মিনিটে হট্টগোলের মুখে তা মুলতবি হয়ে যায়। এরপর ১২টায় অধিবেশন শুরু হলেও আরেকদফা মুলতবির পর বিল উত্থাপন হলে অধিবেশন সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করেন স্পিকার। ওই সময় ছিটানো পেপার স্প্রে এতটাই ছড়িয়েছিল যে মীরা কুমার অধিবেশন কক্ষ লাগোয়া স্পিকারের কার্যালয়ে থাকতে না পেরে বাড়িতে চলে যান বলে পিটিআই জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা বলেন, চোখে-মুখে মরিচের গুঁড়ো লাগায় কাশতে শুরু করেন কাছাকাছি থাকা লোকসভার সদস্যরা। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই সময় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়া সদস্যদের নিরস্ত করতে গিয়ে আহত হন তৃণমূলের এক সদস্য। অসুস্থ হয়ে পড়া এমপিদের শুশ্রূষায় পার্লামেন্টের চিকিৎসককে দ্রুত ডাকা হয়। কয়েকজন এমপিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাম মনোহর লোহিয়া (আরএমএল) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
লোকসভায় মারধর
লোকসভায় মারধর করে, সেক্রেটারি জেনারেলের টেবিলের কাচ ভেঙে দিয়ে, স্পিকারের মাইক উপড়ে ফেলে এবং গোলমরিচের গুঁড়ো স্প্রে করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তেলেঙ্গানার বিরোধী সাংসদেরা। এতে লোকসভার অনেক সদস্য, কর্মী ও সাংবাদিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
১৮ সাংসদকে বরখাস্ত ঘোষণা
লোকসভা থেকে অনেক সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দফায় দফায় গোলমাল ও সভা মুলতবির পর শেষ পর্যন্ত স্পিকার মীরা কুমার কংগ্রেস, তেলুগু দেশম এবং ওয়াই এস আর কংগ্রেসের মোট ১৮ জন সাংসদকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
তেলেঙ্গানা বিল উত্থাপনের দাবি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
দিনভর চলা ওই গোলমালের মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে দাবি করেন, তিনি তেলেঙ্গানা বিলটি উত্থাপন করে দিয়েছেন। এই দাবিকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় নতুন বিতর্ক। কারণ, সভার কর্মতালিকায় তেলেঙ্গানা বিলের উল্লেখ ছিল না। গতকাল বুধবার রাতে কংগ্রেস হঠাত্ করেই তেলেঙ্গানা বিলটি আজ পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পার্লামেন্টের বাইরে প্রস্তুত অ্যাম্বুলেন্স, কম্বল মজুত
কংগ্রেসের কাছে খবর ছিল, বিল উত্থাপনে বাধা দিতে তেলেঙ্গানাবিরোধীরা সহিংসতার আশ্রয় নেবে। এমনকি বিরোধীরা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাতে পারে বলেও সরকারের কাছে খবর ছিল। সরকার তাই পার্লামেন্ট ভবন চত্বরে চারটি অ্যাম্বুলেন্স আগে থেকেই ঠিক করে রাখে। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এবং গাদা গাদা কম্বলও মজুত করা হয়। স্পিকারকে গোয়েন্দারা খবর দেন, কেউ কেউ গ্যালারি থেকে সভাকক্ষে ঝাঁপও দিতে পারেন। এর ফলে এই প্রথম লোকসভার গ্যালারি খালি রাখা হয়।
মারধরের মধ্যেই বিল পেশ
কংগ্রেসের কৌশল ছিল, দিনের কর্মতালিকায় বিলটির উল্লেখ রাখা হবে না। আলাদাভাবে একটি কাগজে তেলেঙ্গানা বিল পেশের উল্লেখ করা হবে এবং সভার শুরুতেই সেটি পেশ করে দেবেন সুশীল সিন্ধে। বেলা ১১টায় সংসদ বসলে এক মিনিটের মধ্যেই মুলতবি হয়ে যায়। দুপুর ১২টায় ওয়েলে পার্লামেন্টদের গিজগিজে ভিড়। কংগ্রেসের রাজ বব্বর, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, লাল সিংরা মন্ত্রীদের আড়াল করতে দাঁড়িয়ে পড়েন। স্পিকার আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সভা মুলতবি হয়ে যায়। এর মধ্যেই সংসদে কাচ ভাঙল, চেয়ার তুলে মারার চেষ্টা হলো, গোলমরিচের গুঁড়ো স্প্রে করা হলো এবং সিন্ধে দাবি করলেন, তিনি বিলটি পেশ করে দিয়েছেন।
সরকারকেই দায়ী করেছে বিরোধীরা
অধিবেশনে তেলেঙ্গানা নিয়ে যা ঘটেছে, সে জন্য বিরোধীরা সরকারকেই পুরোপুরি দায়ী করছে। বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানি, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া, তৃণমূল কংগ্রেসের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জনতা দলের (সংযুক্ত) শরদ যাদব প্রত্যেকেই কংগ্রেসকে দোষী মনে করছেন। প্রত্যেকের বক্তব্য, কংগ্রেস নিজের দলকেই সামলাতে পারল না। এতবার নতুন রাজ্য গঠিত হয়েছে, এমন হাল কোনো দিন হয়নি।
মনমোহন ও জেটলির সঙ্গে বাংলাদেশের স্পিকারের সাক্ষাৎ
এসব গোলমালের মধ্যেই বাংলাদেশের সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রাজ্যসভার বিরোধী দলের নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সন্ধ্যায় সাক্ষাত্ করেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে। গতকাল বুধবার তিনি দেখা করেছিলেন লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারের সঙ্গে।