মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:০০

জীবন যখন ভাসমান হোটেলে

জীবন যখন ভাসমান হোটেলে

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি- অতিথি লেখক

বুড়িগঙ্গার তীরে ওয়াইজ ঘাটে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের সীমানা পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেলে দেখা যাবে, নদীর কালচে পানির মধ্যে নৌকার ওপর পর পর ভাসমান পাঁচটি মরচেপড়া ঘর।

দূর থেকে শুধু ‘শরিয়াতপুর মুসলিম হোটেল’ নামটি স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ‘উমা উজালা হিন্দু হোটেল’ নামটি বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাকিগুলোর গায়ে কোনো নাম নেই। কথা বলে জানা গেল, এই তিনটিরও নাম ছিল- ‘ফরিদপুর’, ‘নাজমা’ ও ‘বুড়িগঙ্গা’ হোটেল। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ ‘নাজমা’র প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত।

ভাসমান এ হোটেলগুলো এলাকায় ‘ভাসমান বোর্ডিং’ হিসেবেই পরিচিত।

বুড়িগঙ্গার তীরে নৌকায় বসবাসের ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। সুবেদার ইসলাম খাঁ যখন ঢাকা আসেন, তখন তার থাকার উপযোগী কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। তিনি থাকতেন শাহী বজরা নৌকা ‘চাঁদনী’-তে। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকতেন ‘ফতেহ দরিয়া’-তে।

শ্রী কেদারনাথ মজুমদার তার ‘ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা সহচর’ গ্রন্থে ১৮৪০ সালে তৎকালীন ঢাকার হোটেলের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে-

‘সেকালে ঢাকাতে কোনো সরাইখানা বা হোটেল ছিল না। আগন্তুক লোক আখরায় ভোজন করিত। শহরের বহু সম্ভ্রান্ত অফিসের কর্মচারীও আখরায় খাইয়া কার্য করিতেন।’

আখরায় আহারের ব্যবস্থা থাকলেও রাত্রিযাপনের জন্য ঢাকায় সে কালে কোনো হোটেল কিংবা হোস্টেল ছিল না। ১৮৬৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় ‘ঢাকাতে হিন্দু হোটেল সংস্থাপনের আবশ্যকতা’ শিরোনামে সংবাদটির বিবরণে জানা যায়-‘….

এ পর্যন্ত ইংরেজদিগের নিমিত্ত ঢাকায় ২টি প্রকাশ্য হোটেল সংস্থাপিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা সাধারণের পক্ষে তাদৃশ উপকারজনক হয় নাই। দুই কারণে তাহা সকলের উপকারে আসিতেছে না। এক, হিন্দুদিগের সে স্থানে প্রকাশ্যরূপে আহার করিলে জাতি রক্ষা পায় না। দ্বিতীয়, উহাতে আহার করা সমধিক ব্যয়সাধ্য হওয়াতে যে সে লোকেরা তথায় আহার করিতে পারেনা।….

’কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, দূর-দূরান্ত থেকে আগত ক্ষুদে ব্যবসায়ী, মামলা-মোকদ্দমাকারী ও সরকারি কর্মচারীরা কোনো কাজে ঢাকা আসলে হোটেল বা ভাড়া বাসার বিকল্প হিসেবে বজরা নৌকায় বসবাস করতেন।

বুড়িগঙ্গার পাড়ে প্রথম হোস্টেল নির্মিত হয় ১৮৭৫ সালে। আইনজীবী হৃদয়নাথ মজুমদার (১৮৬৪-১৯০৫) ঢাকায় অবস্থানকালে লিখেছেন, ‘ভাসমান হোটেলে হাজার হাজার বহিরাগত রাত কাটাত। স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে বজরা নৌকায় বসবাস করত। বজরা নৌকার এই নৌ-হোটেল জনসাধারণের কাছে গ্রিন বোট হিসেবেও পরিচিত ছিল।’

১৯১০ সালে স্যার আর্থার ড্যাশ আইসিএস অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করে বাকল্যান্ড বাঁধে নোঙর করা শখানেক গ্রিন বোট থেকে মাঝিমাল্লা ভাড়াসহ মাসিক ১০০ টাকার বিনিময়ে গ্রিন বোট ভাড়া করেছিলেন। আরো অনেক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ঢাকায় তাদের কর্মকালীন সময়ে সপরিবারে নৌকায় বসবাস করেছেন। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় দ্বিতীয়বার এসে বুড়িগঙ্গায় নবাবদের বজরা ‘তুরাগ’-এ তিন দিন কাটিয়েছেন। ভাসমান হোটেলে থেকেই আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান।

কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের লেখা থেকে জানা যায়, নদীর ওপর বজরায় একটি বাসা ১৫ টাকা মাসিক হারে ভাড়া করলে তিনটি বিশ্রাম কক্ষ তাতে পাওয়া যেত অনায়াসেই। বিকেলে বজরার ছাদে বসে আশেপাশের দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি সুপারহিট গান শোনাটা ছিল অতিরিক্ত পাওয়া।

শিল্পী রফিকুন নবীর (রনবী) স্মৃতিচারণ থেকে যে বজরার বর্ণনা পাওয়া যায়, তার নাম ছিল ‘পিনিস’। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট ছিল অনেকগুলো। কোনো কোনোটি ছিল ‘মুসলিম হোটেল’ নামে। আবার পাশাপাশি কোনোটি ছিল আদর্শ ‘হিন্দু হোটেল’।

এ সবের খাবারের দারুণ সুনাম ছিল। কয়েকটির খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকতে হতো প্রায়ই। হিন্দু হোটেলগুলোর নিরামিষ-ভাজি, মাছ (বিশেষ করে কই, মাগুর আর ইলিশ), আর ঘন ডাল ছিল সবচাইতে মুখরোচক। মুসলিম হোটেলগুলো বিখ্যাত ছিল গরুর মাংস, খাসি আর মুরগি রান্নার জন্য। মুখে চোঙ্গা লাগিয়ে গ্রাহক ডাকতো মেন্যু বলে বলে। হাঁক ছাড়তো ছড়া কেটে-‘ইলিশ ভাজা বড় কই, খাওইনারা গেলো কই?আহেন আহেন আহেন, বহেন বহেন বহেন’।

‘নাজমা’, ‘বুড়িগঙ্গা’ ও ‘উমা উজালা’র বর্তমান মালিক ৮৬ বছর বয়স্ক নওয়াব মিয়া ১৯৪০ সালে এ ব্যবসা শুরু করেন। তখন তার ছিল ১৯টি বজরা। আদিতে এ বজরাগুলোর মালিক ছিলেন ভাওয়াল রাজা, রূপলাল বাবু, নরেন্দ্র নারায়ণ রায় ও হৃষিকেশ বাবুর মতো বিভিন্ন অভিজাত ব্যক্তি। তাদের জন্য বজরার মালিকানা ছিল সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। কালের পরিক্রমায় কয়েক দফা মালিক পরিবর্তিত হয়ে এ বজরাগুলোর মালিকানা পায় নওয়াব মিয়া। ভাওয়াল রাজার বজরাই বর্তমানে নওয়াব মিয়ার ‘নাজমা’। তার মালিকানায় ‘নাজমা’র কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। শুরুতে এর কেবিন ভাড়া ছিল পঁচিশ পয়সা। মাওলানা ভাসানী আত্মগোপন করতে ঐতিহ্যবাহী এ ‘নাজমা’-তে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার অবস্থান করেছেন।

সত্তর দশকে হোটেলগুলোতে থাকার ব্যবস্থা ছিল কেবিনে। কেবিনের বাইরে ছিল খাবার জায়গা। থাকার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষকে কোনো টাকা দিতে হতো না। শুধু খাবার বিল দিলেই চলতো। পরবর্তীতে ভাড়ার হার নির্ধারিত ছিল ১ টাকা। সময়ের বিবর্তনে এখন আর খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু থাকার ব্যবস্থা। এক সময় যে ভাসমান হোটেলগুলোর প্রধান খরিদ্দার ছিল অভিজাতরা, বর্তমানে তা শুধুমাত্র নিম্নবিত্ত-শ্রমজীবী মানুষের মেস-জীবনে পরিণত হয়েছে। এখন হোটেলগুলোতে গেলে দেখা যাবে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভাসমান মানুষের জীবন যুদ্ধের দৃশ্য। ‘ফরিদপুর’ ও ‘শরীয়তপুর’ হোটেল নিম্নবিত্ত, ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা।

কারণ, এখানে ‘উমা উজালা’ ও ‘বুড়িগঙ্গা’র তুলনায় সিটভাড়া কম। ঢালাও বিছানা ২০ টাকা। এ ক্ষেত্রে বোর্ডারকে তার নিজস্ব বিছানাপত্র ব্যবহার করতে হয়। তবে বিছানাপত্রসহ কেবিন ভাড়া ষাট টাকা। ঘুমানোর জায়গাটি মাত্র ৩ ফুট প্রস্থ ও ৫ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি খোপ। মশা ও ছারপোকার সঙ্গে নিত্য সহবাস। ডাবল কেবিন একশ টাকা। সিঙ্গেল কেবিনের তুলনায় সামান্য কিছুটা প্রশস্ত। কেবিনে সিলিং ফ্যানের ব্যবস্থা আছে। বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বছরের পর বছর এ হোটেলগুলোতে অবস্থান করছেন।আকার-আকৃতিতে ভাসমান হোটেলগুলোর মধ্যে ‘উমা উজালা হিন্দু হোটেল’টিই সবচেয়ে বড়, যার আদি মালিক ছিলেন মদনমোহন কুণ্ডু। এক সময় ছিল তিনতলা। আগুনে পুড়ে যাওয়ায় বর্তমানে দোতলা। হোটেলে বিনোদনের জন্য আছে টিভির ব্যবস্থা। সিঙ্গেল সিট ৭০ টাকা এবং ডাবল সিট ১৪০ টাকা। ঢালাও বিছানার কোনো ব্যবস্থা নেই।

এখানে থাকেন বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীরা এবং ঢাকায় চিকিৎসা করতে আসা ভাসমান মানুষ। ভাসমান হোটেলগুলোতে যাওয়ার জন্য নদীর তীর থেকে রয়েছে বাঁশ, কাঠ বা লোহার সাঁকো। হোটেলগুলোর সব ধরনের বর্জ্য-নিষ্কাশন চলছে সরাসরি নদীতেই। নদীর বিষাক্ত ও গন্ধযুক্ত পানি দিয়ে গোসল করা যায় না। নদীর পাশের সরকারি কলে ১০ টাকা দিয়ে সারতে হয় গোসল। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে হোটেল পরিচালনার জন্য দিতে হয় নির্ধারিত মাসিক ভাড়া। প্রতিটি হোটেলের মাসিক আয় গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা। স্মৃতিকাতর হয়েই বর্তমান মালিকেরা এ ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন আজও।

গ্রিন বোটের মধুময় অতীত আজ শুধুই স্মৃতি। সময়ের ভেলায় ভাসতে ভাসতে গয়না-বজরা আজ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এদেরই প্রতিভূ হিসেবে আজও গোটা পাঁচেক স্টিল বডির নৌকা শ্রমজীবী স্বল্প আয়ের মানুষের ক্ষণস্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক এই নৌকাগুলোকে যদি আধুনিকতার স্পর্শে নান্দনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত করে তোলা যেতো তাহলে হয়ত ঢাকার পর্যটন শিল্প বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বুড়িগঙ্গাও রক্ষা পেতো।-

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025