মেহেদী হাসান: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও অব্যাহত অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশ গত কয়েক বছর বিদেশিদের কাছে বিনিয়োগের আদর্শ দেশ। ৬ শতাংশ জিডিপি আর মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন সূচকে প্রতিবেশী অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হয়ে উঠেছে আরো আকর্ষণীয়। তবে এই ঈর্ষণীয় সম্ভাবনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক সংকট সাম্প্রতিক সময়ে আরো সহিংস হয়ে ওঠায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক বার্তা আরো প্রবলভাবে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে কমছে বিনিয়োগ। এরই মধ্যে কুয়েতের বিনিয়োগ পিছিয়ে যাওয়ার দুঃসংবাদ এসেছে। কাতার বলেছে, তারা বড় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। শর্ত একটাই, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিদেশি এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ২১টি। এর আগের মাস জানুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল দেড় শতাধিক। দেশীয় বিনিয়োগের পরিমাণও কমছে।
ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরা বছরখানেক আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে এ দেশের ভাবমূর্তি সংকটের কথা বলেছিলেন। তাঁরা সতর্ক করে বলেছিলেন, এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অন্যত্র চলে যাবেন। তাঁদের সেই আশঙ্কার পর বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত, অনিশ্চয়তা অনেক প্রকট হয়েছে। হরতাল-সহিংসতার খবর প্রকাশ পাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা চলছে। ওই দেশগুলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের শর্ত দিচ্ছে।
কুয়েতের বিনিয়োগ পেছাল : চলতি মাসেই ঢাকা সফর করার কথা ছিল কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহর। এ সফরে এ দেশের বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কুয়েতের বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছিলেন। ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে তেল শোধনাগার স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, ডুলাহাজারা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ নির্মাণ সম্ভাব্য প্রকল্পগুলোর অন্যতম ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশীদের জন্য কুয়েতের শ্রমবাজার আবার খোলার ব্যাপারেও আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। তবে গত ১২ মার্চ হঠাৎই কুয়েতের পক্ষ থেকে ওই সফর বাতিল করা হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, কুয়েতের আমিরের পূর্বনির্ধারিত বাংলাদেশ সফরের সময় আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আমির গুরুত্বপূর্ণ ওই সম্মেলনে অংশ নেবেন। তাই বাংলাদেশ সফর করতে পারবেন না।
সফর বাতিলের ফলে দৃশ্যত কুয়েতের বিনিয়োগ সম্ভাবনা পিছিয়ে গেল। সফর বাতিলের পেছনে বাংলাদেশে সংঘাত ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজ করেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কুয়েতের আমির সফর বাতিলের পেছনে যে কারণ দেখিয়েছেন তা যৌক্তিক। কিন্তু সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সুবিধাজনক কোনো সময়ে সফরের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করা হয়। কুয়েতের বার্তায় তেমনটি ছিল না।
সূত্র আরো জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক সময়ই শীর্ষ পর্যায়ের সফর বাতিল হয়। তা ছাড়া কুয়েতের আমিরকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। তিনিও মারা যাওয়ায় এ সফরের আর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
স্থিতিশীলতার শর্ত কাতারের : গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই ঢাকায় কাতারের দূতাবাস ৪ মার্চ দোহায় বাংলাদেশ ও কাতারের বিনিয়োগবিষয়ক যৌথ কর্মকমিটির প্রথম বৈঠকের পরিকল্পনার কথা জানায়। দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে দোহায় পৌঁছে অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব মুস্তাফা কামালের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। মানবতাবিরোধী অপরাধে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক সংঘাত ও প্রাণহানির খবর বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। এরই মধ্যে দোহায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (যৌথ অংশীদারিত্বে অথবা কাতারের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ওয়াটার কম্পানিসহ আন্তর্জাতিক আরো অংশীদারের সহযোগিতায়), ১৭৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় ও চতুর্থ টার্মিনাল, দুটি হ্যাঙ্গার, কার্গো ভিলেজ, সমান্তরাল রানওয়ে নির্মাণসহ আধুনিকায়ন বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, নদী খনন মাটির সদ্ব্যবহার, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ ও নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা হয়।
ষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কুয়েত সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৮০ কোটি ডলার আমানত হিসেবে রাখারও প্রস্তাব দেয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশসহ সমপর্যায়ের যেকোনো দেশের জন্য এসব বিনিয়োগ প্রস্তাব আকর্ষণীয়। এগুলো পাওয়া গেলে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে। কিন্তু এসব পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।
দোহায় বিনিয়োগবিষয়ক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের এমন একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে জানান, কাতারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আহমেদ বিন মোহাম্মদ বৈঠকে বলেছেন যে তাঁর দেশ বিদেশে সব খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু কাতার এখন সেসব দেশের দিকেই ঝুঁকছে যেসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং যথার্থ বিনিয়োগ পরিবেশ আছে।
ওই বৈঠক সম্পর্কে গত ৫ মার্চ গালফ টাইমসে প্রকাশিত ‘কাতার, বাংলাদেশ ডিসকাস ওয়েস টু বুস্ট ইনভেস্টমেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও কাতারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য স্থান পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকে বসে কাতারের মন্ত্রীর ওই বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
পরবর্তী কার্যক্রমও ব্যাহত : সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী শেখা লুবনা বিনতে খালিদ আল কাশিমি গত জানুয়ারি মাসে ঢাকা সফরকালে বড় বিনিয়োগ করার ইঙ্গিত দেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ইউএই কঙ্বাজার ও মংলায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ও ঢাকার কাছে ‘ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি)’ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরের পর এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব এক্ষেত্রেও পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ পর্যায়ের বিদেশি প্রতিনিধিরা এ দেশ সফরের সময় বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে সেগুলো বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজ হয়।
সূত্র আরো জানায়, বিনিয়োগের পথ সুগম করতে কাতারের সঙ্গে শিগগির কারিগরি, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতাবিষয়ক একটি চুক্তি এবং বিনিয়োগ সুরক্ষা ও উৎসাহিতকরণ চুক্তি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া গত জানুয়ারি মাসে কাতারের সঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিবিষয়ক সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) মেয়াদ শেষ হয়েছে। এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এলএনজি প্রয়োজন হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে কুয়েতের ১৮০ কোটি ডলার আমানত রাখা সহজ করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে একটি এমওইউ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ত্বরান্বিত করতে জ্বালানি খাতে কুয়েতের সঙ্গে সহযোগিতাবিষয়ক একটি এমওইউ স্বাক্ষর করা দরকার।
কুয়েতের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, এসব চুক্তি/এমওইউ স্বাক্ষরের জন্য দরকার উচ্চ পর্যায়ের সফর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বর্তমান মেয়াদে এরই মধ্যে তিনবার কাতার সফর করেছেন। এখন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হামিদ বিন জসিম বিন জাবের আল থানির অন্তত এক দিনের জন্য হলেও বাংলাদেশ সফর করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হলে কাতারের প্রধানমন্ত্রীসহ বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সফরে উৎসাহিত করা যাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক দাবি করেন, টানা দুই বছর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তিনি বিদেশ থেকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অন্তত এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ আনতে পারবেন।
স্থিতিশীলতা থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বারবার বলছেন, বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। চীন থেকে বিনিয়োগ অন্যত্র সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে ওই বিনিয়োগগুলো এ দেশেই আসবে।
সংঘাত ধ্বংসাত্মক : অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের খবর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর কী প্রভাব ফেলে জানতে চাইলে ঢাকার এক ইউরোপীয় কূটনীতিক গত ৯ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংবাদ সম্মেলনে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত সেন্ড অলিংয়ের বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রদূত সেন্ড অলিং বলেছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সাহায্য দেওয়ার সম্পর্কের বদলে বাণিজ্য ও অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়তে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা তাদের দেশের বিনিয়োগ, কম্পানিগুলোতে বাংলাদেশে আসতে উৎসাহিত করেন। এ জন্য তারা বাংলাদেশে ব্যবসার সুযোগবিষয়ক নিবন্ধ, টিভি অনুষ্ঠান দেখানোর পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে এ দেশ নিয়ে অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনার কথাও বলেন। কিন্তু রাস্তায় সহিংসতা, সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা ও যোগাযোগ না থাকার খবর যখন সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়, তখন তাঁদের সব প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়।
Leave a Reply