সোলায়মান তুষার: নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রণীত স্কুলের বইয়ে ‘ব্লু ফিল্ম’ ও যৌনতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। অষ্টম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৮৬নং পৃষ্ঠায় শেষের প্যারাতে লেখা হয়েছে শিশু কিশোরদের খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে পর্নোগ্রাফি, ব্লু ফিল্ম ও বিভিন্ন অশ্লীল প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে। লন্ডনে অবস্থানরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া তার ছোট বোন একদিন তাকে প্রশ্ন করেন ভাইয়া ‘ব্লু ফিল্ম’ কি ? ‘তুমি এ শব্দ কোথায় পেলে’ জানতে চাইলে তার বোন বলে, আমাদের বইয়ে এটা পেয়েছি। ওই শিক্ষার্থী লিখেছেন, আমার বোনের কাছ থেকে একথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। তিনি লিখেন, কারিকুলাম প্রণেতাদের যেন আর কোন কাজ নেই। কারিকুলাম প্রণেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ‘ব্লু ফিল্ম’ শব্দটি না লিখলেই ভাল হতো। শিশুদের আঙুল দিয়ে এসব বিষয় দেখিয়ে দেয়া উচিত নয়। অষ্টম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের পাশাপাশি নবম-দশম শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়েও রয়েছে নানা আপত্তিকর শব্দ। অভিভাবক ও শিক্ষককরা অভিযোগ করে বলেছেন, এসব শব্দ ব্যবহার করে আমাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইটির ৮৪ নম্বর পৃষ্ঠায় কিশোর অপরাধের ধারণা বিষয়টিতে বিভিন্ন ধরনের কিশোর অপরাধের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে পর্নো বা নোংরা ছবি দেখা কিশোর অপরাধ। ৮৫ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, দরিদ্র শিশুরা অল্প বয়সেই নানা কাজ করে টাকা উপার্জন করতে বাধ্য হয়। এই টাকায় কখনও কখনও তারা জুয়া খেলে, মদ-গাঁজা খায় এবং নোংরা ছবি দেখে। ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠায় আগের বিষয়টির সঙ্গে এবং ৮৮ নম্বর পৃষ্ঠাতেও পর্নোগ্রাফি কথাটির আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া নবম-দশম শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে যে বিষয়গুলো হারাম তার মধ্যে ৭ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম সেবন করা।
ষষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ে যৌনতা নিয়ে: ২০১৩ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণীর নতুন প্রণীত শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয় বইটিতে ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘আমাদের জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল’ শীর্ষক অধ্যায়। এই অধ্যায়ে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের পরিবর্তন এবং করণীয় বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বইটির ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ছেলেদের পরিবর্তনগুলো শিরোনামের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে জ. নম্বরে দেয়া হয়েছে বীর্যপাত হয়। মেয়েদের পরিবর্তনগুলোর মধ্যে ক. মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হওয়া, খ. মেয়েদের কোমরের হাড় মোটা, উরু ও নিতম্ব ভারি হয়, গ. মেয়েদের বুক বড় হয়ে ওঠে। ৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক পরিবর্তন শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে- গ. যৌন বিষয়ে চিন্তা আসে। ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠ ২-এ উল্লেখ করা হয়েছে- ছেলেদের মধ্যে বড় পরিবর্তন হচ্ছে বীর্যপাত। অনেক সময় ঘুমের মধ্যে এটা ঘটতে পারে। মেয়েদের বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রথম পরিবর্তন ঋতুস্রাব হয়। মেয়েদের গোপন অঙ্গ থেকে যে রক্তপাত হয় তা দেখে তারা ভীত ও দিশাহারা হয়ে পড়ে। একই পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন বিষয়ে দু’টি পৃথক ছক দেয়া হয়েছে। যে ছকটি ছেলে-মেয়েদের পূরণ করার জন্য রাখা হয়েছে। ৪২ নং পৃষ্ঠায় কাজ ১-এ লেখা আছে, বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে যেসব ঝুঁকির সৃষ্টি হয় তা একটি দল প্রথমে বোর্ডে লিখবে। এর ওপর অন্যদল আলোচনা করবে।
কাজ ২-এ উল্লেখ করা হয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন সম্পর্কে জানা থাকার সুবিধা এবং জানা না থাকার অসুবিধাগুলো পোস্টারে লিখে রাখবে। ৪৬ পৃষ্ঠায় বলা হচ্ছে ছেলেদের বীর্যপাত হলে কিভাবে পরিচ্ছন্ন হতে হবে, দাড়ি, গোঁফ কামাতে কিভাবে রেজার, ব্লেড, শেভিং ক্রিম ব্যবহার করতে হবে তা অভিভাবক থেকে জানবে। ৪৭নং পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে ঝুঁকি শিরোনামের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা যেসব ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তা উল্লেখ করে ২ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, কৌতুহলের বশে বা খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ধূমপান, মাদকাসক্তি, অবৈধ ও অনিরাপদ যৌন-আচরণসহ নানা ধরনের অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। ৩ নম্বরে বলা হচ্ছে, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে প্রজননতন্ত্রে নানা ধরনের রোগ সংক্রমণ বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকির আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। ৪৮ নং পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালের ঝুঁকির নিরাপত্তার জন্য অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। কিভাবে তারা তাদের সন্তানদের খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখবেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের শব্দ স্কুলের বইয়ে ব্যবহার করা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মানায় না। এটা অভিভাবকরা অদভুত মনে করেন। এটা সত্য শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা থাকা দরকার। তবে এর মধ্যে শালীনতা থাকতে হবে। কারিকুলাম প্রণেতা অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিশুদের এসব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি করা সঠিক নয়। তবে শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
সুত্র: মানবজমিন।
Leave a Reply