পুলিশের কাছে তথ্য আছে, নেপালের এসব সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে ভারত হয়ে ছদ্মবেশে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তারা এদেশের উগ্রপন্থী মৌলবাদি সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে তাদের সক্রিয় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কক্সবাজার এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামকে তারা ঘাঁটি বানানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলেও তথ্য আছে পুলিশের কাছে।
এছাড়া একটি বিদেশি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এনজিও নেপালি মৌলবাদি সংগঠনগুলোকে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। নেপালের পাঁচটি ইসলামী সংগঠনের বাংলাদেশ নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠার তথ্য পেয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে জরুরি ফ্যাক্স বার্তা পাঠিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে। এরপর থেকে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ নেপালের পাঁচ মৌলবাদি সংগঠনের খোঁজে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। সতর্ক দৃষ্টি রাখছে কয়েকটি বিদেশি সমর্থনপুষ্ট কয়েকটি প্রভাবশালী এনজিওর উপরও।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, নেপালের সংগঠনগুলোর বাংলাদেশ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। মূলত সিএমপি’র দু’টি গোয়েন্দা ইউনিট এ বিষয়ে বিভিন্ন লেভেলে কাজ করছে। নেপাল হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র হলেও কয়েকটি জেলায় ৫০ শতাংশের বেশি মুসলমানের বসবাস। এসব এলাকায় মূলত পাঁচটি সংগঠন বেশি তৎপর। বাংলাদেশে তারা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বলে কিছুু তথ্য আছে। আপাতত বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের আগস্টে বিহার-নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার বোমা বিশেষজ্ঞ আব্দুল করিম টুন্ডা এবং জঙ্গী সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াছিন ভাটকলকে পৃথকভাবে গ্রেপ্তার করে। ভারতীয় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উভয়ই জানিয়েছিল, তারা দু’জনই ভারত থেকে নেপাল হয়ে বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
নেপালের মৌলবাদি সংগঠনগুলোর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহকারী নগর পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, কর্নাটকের ভাটকাল এলাকার বাসিন্দা ইয়াসিনের আসল নাম আহমেদ সিদ্দিবাপ্পা। ২০০৭ সালে ইয়াসিন ভাটকাল এবং তার দু’ভাই রিয়াজ ও ইকবালের হাত ধরে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের জন্ম। প্রায় সারা ভারত জুড়ে একের পর এক হামলা চালিয়েছে তারা। প্রতিটি বিস্ফোরণের পর নিয়ম করে সংবাদমাধ্যমে ই-মেইল পাঠিয়ে দায়িত্বও স্বীকার করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের দিল্লিতে জন্ম নেয়া আব্দুল করিম টুন্ডার জঙ্গি হিসেবে উত্থান ঘটে আশির দশকে। ১৯৮৫ সালে বোমা বানাতে গিয়ে তার এক হাত উড়ে যায়। ১৯৯৩ সালের মুম্বাই বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে কমপক্ষে ৩৩টি মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিল টুন্ডা।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নেপালের ইসলামী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ রেখে চলা টুন্ডা ও ভাটকলের সংগঠনের পরবর্তী টার্গেট ছিল বাংলাদেশ। তবে টুন্ডা এবং ভাটকল গ্রেপ্তার হলেও বাংলাদেশে নেপালের সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক বিস্তারের কার্যক্রম থেমে থাকেনি বলে পুলিশের কাছে পাঠানো সতর্কবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব সংগঠনের সদস্যদের বাংলাদেশে যাতায়াত এবং মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও ওই বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
পুলিশ সূত্রমতে, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম প্রধান একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও মৌলবাদি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বাড়ানোর পুরো কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। তারা দীর্ঘসময় ধরে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় জেলা বারা, মহাওয়া, ধনুশা, সিরহা এবং সেনরি জেলার মুসলমান নাগরিকদের ভারত হয়ে বাংলাদেশে অভিবাসনে সহযোগিতা করছে। আবার মায়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে অনেক রোহিঙ্গা নেপালি ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে এসব অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত জানুয়ারিতে চারজন বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীকে নেপালের ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করে। তারা বাংলাদেশি জাল পাসপোর্টধারী এবং নিজেদের রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করে। সূত্রমতে, নেপালের পাঁচটি মৌলবাদী সংগঠন নেপালের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বেশি তৎপর। ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের সীমান্তবর্তী নেপালের বাকে, কপিলাবস্তু, পার্সা এবং রাওয়াহাটের মোট বাসিন্দার প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মুসলিম। এসব এলাকায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আর্থিক সহায়তায় প্রায় ৩৫০টি মসজিদ এবং ৩০০টি মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে।
নেপালের মৌলবাদি সংগঠনগুলোর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহকারী নগর পুলিশের ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন এনজিও নেপালের মুসলিম প্রধান এলাকাগুলোতে মৌলবাদি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা দিচ্ছে। এসব এনজিও’র কয়েকটি বাংলাদেশেও তৎপর। মূলত বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এনজিও, একটি আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং বাংলাদেশি বিভিন্ন উগ্রপন্থী মৌলবাদী সংগঠনের নেতারা একটি যৌথ নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কারও বিষয়ে প্রমাণযোগ্য কোন তথ্য আমরা পাইনি।
পুলিশের সতর্কবার্তায় আর্ন্তজাতিক দাতা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সাহায্যপুষ্ট স্থানীয় ও বিদেশি এনজিওগুলোর তৎপরতার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রমতে, সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ভারতে নেপালি নাগরিকদের কোন ধরনের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রয়োজন না হওয়ায় তারা সহজেই ভারতে ঢুকে সড়কপথে বাংলাদেশে আসছে। নেপালি সদস্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মান, তুরস্ক, স্পেন, হল্যান্ডের নাগরিকরাও ট্যুরিস্ট ভিসায় নেপালে এসে সেখান থেকে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সূত্র জানায়, এদের অনেকের বাংলাদেশে ‘অন অ্যারাইভালি ভিসা’ সুযোগ থাকলেও তারা তা এড়িয়ে সড়কপথে নেপাল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায়। অনেক ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ সফরের আসল উদ্দেশ্য আড়াল করতে এনজিওগুলোর আমন্ত্রণপত্র ভিসা আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত না করে সাধারণ পর্যটক হিসেবে ভিসা নিতে তৎপর থাকে। সতর্ক বার্তায় অবিলম্বে নেপাল থেকে ভারত হয়ে সড়ক পথে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টগুলোতে কঠোর নজরদারি এবং অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রমতে, যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দেয়া একটি এনজিও নেপালে অনুরূপভাবে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তুরস্কের একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যেটির বিরুদ্ধে ২০১১ ও ২০১২ সালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে অননুমোদিত কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ উঠেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটিও নেপালে তৎপর। একইভাবে একটি মানবাধিকার সংগঠন, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মুসলিম দেশে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ঋণদানকারী একটি দাতা ব্যাংক এবং একটি খ্যাতিমান এনজিও’র নেপাল শাখাসহ আরও কয়েকটি সংগঠন নেপালের বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসাকেন্দ্রিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে।