ফকীহুল ইসলাম নওরোজ : মানবাধিকারের মূল কথা হচ্ছে, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও শান্তি। সেখানে থাকবে না অভাব, থাকবে না শঙ্কা। কোনো অন্যায় না করেও কেবল জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কারো অধিকার খর্ব করা হবে গণতান্ত্রিক সমাজে সেটি হতে পারে না। যেহেতু আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি, আমার কতগুলো অধিকার প্রাপ্য আছে। সেগুলো দেওয়ার বিষয় নয়, আমার প্রাপ্য। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করাই হলো মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা যদি মানবাধিকারের কথা বলি, তবে এই শর্তগুলো, এই সূত্রগুলো আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে, এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আমাদের আচার-আচরণে, চালচলনে-নীতিতে, আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের সামাজিকতায়, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর প্রতিফলন থাকতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল কথাও ছিলো সেটি। অনেক কষ্ঠ, অনেক হতাশার মধ্যেও আমাদের জীবনে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু ঘটনা আছে। আমাদের আছে গৌরবময় ভাষা আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করলাম, পাকিস্তানী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বেরিয়ে এলাম- এও তো একটা বড় পাওয়া। ধর্মের নামে গঠিত দেশ পাকিস্তানে কী অধর্ম ও হানাহানি চলছে, আমরা জানি। সেখানে মানুষকে ছোট্ট একটা গন্ডিতে নিয়ে আসা হয়েছে, তার দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে তো মানুষ বাঁচতে পারে না। পাকিস্তান থেকে যে আমরা আলাদা হলাম সেটি তো শুধু ভৌগলিক ব্যাপার ছিল না ছিল আদর্শের বিষয়ও।
বর্তমান সমাজে আজ এত অন্যায় অত্যাচার হচ্ছে, আমরা তার প্রতিবাদ করছি না। তাহলে মানবাধিকার রক্ষা পাবে কী করে? অভিজ্ঞতায় দেখি, পরিবারের মধ্যেও নৃশংসতা বাড়ছে। একই ছাদের নিচে বাস করেও যে মানুষটা একটু দুর্বল তাঁর উপর সবল কী পরিমান নির্যাতন করছে? যারা নিয়োগকর্তা তারা গৃহকামীদের ওপর নির্যাতন করছেন। কোনো মানুষ যদি সেখানে প্রতিবাদ করার জন্য দাঁড়াচ্ছে, তার ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালাচ্ছে। আবার অনেকে গা বাঁচিয়ে চলছেন। ভাবছেন তার ওপর তো আক্রমণ আসেনি। এই প্রতিবাদ না হওয়ার কারণে সমাজে ন্যায় ও মূল্যবোধ তৈরী হচ্ছে না। আগে অন্যায়কারীরা লুকিয়ে ছাপিয়ে অপরাধ করত। এখন প্রকাশ্যে ও দল বেঁধে সংগঠিতভাবে করছে। তার চেয়েও বড় কথা এসবের জন্য তারা লজ্জিত হচ্ছে না। সত্যি বলতে কি, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আমরা ভীষণ স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর হয়ে পড়েছি। যে যেভাবে পারছে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, শাস্তি দিচ্ছে। এই যে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড চলছে, সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ না করে তাকে সমর্থন করছে। আমরা যারা এ ধরনের হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে, তাঁদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এখানেও মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নটি জড়িত। বিচার না করে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না। সমাজে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধা ছিল, সেটি এখন প্রায় আবসিত। আরেকটা বিষয়, আমরা ভীষনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, আমাদের পাশের ফ্লাটে কোন মানুষটা আছে আমি জানি না। আমি সমাজের মধ্যে কোনো একটা সামাজিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত হতে পারছি না, কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে গিয়ে কীভাবে একজন আরেকজনকে হটিয়ে দেবে, কীভাবে সুযোগ-সুবিধা আদায় করবে, সেটি নিয়ে ব্যস্ত থাকছে সবাই। কেউ কাউকে এতটুকু জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি নন। এর ফলে যারা একটু দুর্বল, তারা কিছুতেই এগোতে পারছেন না। গণতন্ত্রের যে একটা বিরাট সুযোগ, শাসন-প্রক্রিয়ায় সব মানুষের অংশগ্রহণ, সেটা ঘটছে না। নারী-ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু যারা, যারা অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে দুর্বল- তাদের অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না।
এখন এমন একটা অবস্থায় আমরা পৌঁছেছি, যেখানে কথা বলতেও বড় ভয়। এখন অনেকেই বলছেন, কথা না বললে হবে না। কথাগুলো যদি আমরা অনেক দিন আগে থেকে বলতে শুরু করতাম, তাহলে এই জায়গায় এসে পৌঁছতাম না। এই যে কথা- না- বলার সংস্কৃতি, এই যে ভয়ে বুকে চেপে নিয়ে নিজের পিঠ বাঁচানোর সংস্কৃতি এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখতে পাই কথা কেবল তারাই বলবেন, যাদের হাতে ক্ষমতা আছে। আর কেউ যেনো কথা বলতে পারবেন না। ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ আছে, তাদেরও কিছু বলার আছে। সে কথাগুলো কে বলবে? যারা ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আছেন, তাঁরা হুমকি ধুমকি দিয়ে চলেছেন। তারা বেশ গুছিয়ে গাছিয়ে নিজেদের জায়গা তৈরী করে নিয়েছেন, সেটার বাইরে যেন বাংলাদেশ নেই। দেশটা যেনো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
এখানে নাগরিক সমাজেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে যে তারা যেন সরকারকে, রাষ্ট্রকে, সমাজকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করে। জবাবদিহি আদায় করাটা নাগরিক সমাজের কর্তব্য। অনেকেই ভাবেন, কথা না বলে, অন্যায়ের প্রতিবাদে না করে ঝুঁকি এড়াচ্ছেন। সেটা আসলে ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। অতএব, আমাদের কথা না বলার সংস্কৃতিটা বদলাতে হবে। যারা দুর্বল সুবিধা বঞ্চিত তাদের পক্ষে কথা বলতেই হবে।
পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিক সমাজের একটা বড় ভূমিকা থাকে এবং নাগরিক সমাজকে মানুষও সম্মান করে চলে। সেই বিষয়টা যদি আমাদের সমাজে না হতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলো সারাক্ষণ নাগরিক সমাজকে প্রতিপক্ষ ভাবে কিংবা ষড়যন্ত্রকারী মনে করে, তার ফল ভালো হতে পারে না।। নাগরিক সমাজই তাদের সচেতন করে দেয়, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়। তাদের মুখ বন্ধ করলে, রাজনীতিকদের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়ার কেউ থাকবে না। যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদেরই বেশি নজর দেয়া উচিত। কান পেতে রাখা উচিত নাগরিক সমাজের প্রতি। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজকেও স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন সত্তা নিয়ে চলতে হবে, সব ধরনের চাপ প্রতিহত করার শক্তি রাখতে হবে। গণতন্ত্রে নাগরিক সমাজের মুখপত্র হিসেবে কাজ করে এই গণমাধ্যমগুলো। তাদের তো পার্লামেন্ট নেই, সংগঠন নেই। তাদের কথাগুলো কীভাবে বলবে, কোথায় বলবে? গণমাধ্যমই হতে পারে তাদের প্লাটফরম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্যও অপরিহার্য। যারা জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যান, তাদের মনে রাখতে হবে, জবাবদিহি ছাড়া গণতন্ত্র হয়না। অনেক সময় ক্ষমতাসীনেরা ভাবেন, আমরা যা খুশী করতে পারি, কেউ সমালোচনা করতে পারবে না। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আবার যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন, তাঁরা মনে করেন যেনতেন প্রকারে সরকারকে উৎখাত করতে হবে। সেটিও সুস্থ চিন্তা নয়।
বাংলাদেশে মানুষ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একাধিকবার অগণতান্ত্রিক শাসন এসেছে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে জনগনের দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হয়নি। একটা মুক্ত পরিবেশ পেলে তারা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করতে চায়। একজন আরেকজনকে হাত ধরিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যখনই একটু খানি নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পেয়েছে মানুষ। তখনই তারা অসাম্প্রদায়িক, গণমুখী এবং সবার জন্য মঙ্গলকর সমাজ গড়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করছে।
আমরা আশা করব, মানুষের যে মৌলিক অধিকারগুলো আছে, মানবাধিকারের যে চিন্তাগুলো আছে, সেগুলোর প্রতি সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব শ্রদ্ধাশীল হবে। সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা হবে এটাই এবারের স্বাধীনতার মাসের ক্রান্তিকালে সকলের প্রত্যাশা।
Leave a Reply