টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ এপ্রিলকে অভিহিত করেছিলেন নিষ্ঠুরতম মাস হিসেবে। মূলত প্রকৃতির প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে এপ্রিল বা চৈত্র-বৈশাখ মাস মোটেই নিষ্ঠুর নয়। এই মাসে বাংলা নববর্ষ থাকায় ব্যবসায়ীরা হালখাতা খোলেন। কৃষকেরা নতুন ফসল রোপণের প্রস্তুতি নেন। আবহমান কাল থেকেই গ্রামে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এখন সেই উৎসবের ঢক্কানিনাদ শহরেও শোনা যাচ্ছে। বাড়ছে বেচাকেনাও।
বাংলাদেশের মানুষ এই এপ্রিলের নিষ্ঠুরতার প্রথম অভিজ্ঞতা লাভ করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল বা পয়লা বৈশাখে; সেদিন ভোরে রমনার বটমূলে আয়োজিত ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শকের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন জঙ্গি বোমা হামলা চালিয়ে নয়জন নারী-পুরুষের জীবন কেড়ে নেয়। এর আগে এই জঙ্গিগোষ্ঠীই যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা করেছিল। ঘাতকদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও গত ১৩ বছরেও সেই হত্যার বিচার হয়নি। কবে হবে, সে কথাও কেউ বলতে পারে না। আমরা বিচারহীনতার মধ্যে বসবাস করছি নতুন বিচারের আশায়।
এই এপ্রিলেই দেশ আরেকবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তখন ক্ষমতায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা। জঙ্গিদের ভয়াবহ উৎপাত। ক্ষমতাসীন শিবিরে চরম অসন্তোষ, বিদ্রোহ। সরকারি দলের পীড়ন ও বিরোধী দলের আন্দোলনে জনগণ তখন দিশেহারা। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিলেন, ‘তাঁর হাতে ট্রাম্পকার্ড আছে এবং ৩০ এপ্রিলের মধ্যে খালেদা জিয়া সরকারের পতন ঘটবে।’ এমনকি তিনি এও বললেন, ‘৩০ এপ্রিলের পর খালেদা জিয়া দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ঠিকই, তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন, বিরোধী দলের নেতা হিসেবে।’ এরপর এপ্রিলের শেষ ১০ দিনে আওয়ামী লীগ হাওয়া ভবন ঘেরাও, তিন দিনের গণ-অনাস্থা এবং দুই দিনের হরতালের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশ ছিল টালমাটাল। বিরোধী দলকে ঠেকাতে সে সময়ে সরকার ঢাকা শহরেই পাঁচ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করেছিল। বিভিন্ন বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনেও পাকড়াও করা হয়েছিল বাইরে থেকে আসা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে। সরকারের আশঙ্কা ছিল, আওয়ামী লীগ আহূত কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকায় আনা হচ্ছে, যেকোনো উপায়ে তাদের আটকাতে হবে। আটকানো হলো। জেলখানা ভরে গেল। রাজনৈতিক মহলে তখন গুঞ্জন ছিল, বিএনপির ১০০ জন সাংসদ পদত্যাগ করে বিরোধী দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবেন।
কিন্তু শেষমেশ ৩০ এপ্রিল ২০০৪ কিছুই ঘটেনি। আব্দুল জলিলের ট্রাম্পকার্ড ব্যর্থ হয়েছিল।
আজ ৬ এপ্রিলের আগে ও পরের ঘটনাবলি নয় বছর আগের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঘটনাগুলো একই খাতে প্রবাহিত না হলেও অনেক মিল আছে। সেদিন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ডাক দিয়েছিল। আজ বিএনপির নেতারা বলছেন, ‘সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ সেদিনও রাজনৈতিক স্বার্থে মহল বিশেষ ধর্মকে ব্যবহার করেছিল, আজও করছে।
দেশজুড়ে মানুষের মনে গভীর শঙ্কা, ভয়। সবাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। আর এই উৎকণ্ঠা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ৬ এপ্রিল ঘোষিত লংমার্চ এবং সমাবেশকে কেন্দ্র করে। গতকাল ভোর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে বাস, লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। কোথাও কোথাও কর্মীদের আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও তাঁরা সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর করেছেন। হেফাজতে ইসলাম বলেছে, ‘যেখানে বাধা সেখানেই অবরোধ।’ সরকার বলছে, ‘তাদের কাছে খবর আছে, এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নাশকতা ঘটাবে।’ পরিবহনমালিকেরা বলছেন, ‘নাশকতার ভয়ে তাঁরা গাড়ি বের করছেন না।’
শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী তাঁর ভক্তদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন শুকনা খাবার নিয়ে লংমার্চে অংশ নিতে আসেন এবং যেখানে বাধা পাবেন সেখানেই বসে আল্লাহর নাম নেন। কিন্তু এখন সংগঠনের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, লংমার্চে বাধা দেওয়া হলে সেখানেই তাঁরা অবরোধ করবেন। তাঁরা আরও দাবি করেছেন, ২৩টি সংগঠনের হরতাল প্রত্যাহার করা না হলে রোববার থেকে লাগাতার হরতাল পালন করা হবে।
লাগাতার হরতাল! এমনিতেই মার্চ মাসটি হরতালে হরতালে কেটেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠতে বসেছে। হেফাজতে ইসলাম এমন সময়ে তাদের কর্মসূচি দিয়েছে, যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শাহবাগে তরুণেরা আন্দোলন করেছিলেন। গণতান্ত্রিক সমাজে যে যার কর্মসূচি নির্বিঘ্নে পালন করবেন। কেউ কারও কর্মসূচিতে বাধা দেবেন না। কাউকে আসতেও বাধ্য করবেন না। কিন্তু চট্টগ্রামে তরুণদের কর্মসূচি পালন করতে দেননি হেফাজতে ইসলামের নেতারা। তাঁরা তাঁদের কর্মসূচিকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক দাবি করেছেন। আবার সরকারবিরোধী সব দল একজোট হয়ে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে সমর্থনও জানিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম এত দিন বলে আসছে, তারা জামায়াত-শিবিরবিরোধী। তাহলে এখন কীভাবে জামায়াত তাদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানাল?
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সব পক্ষ কর্মসূচি ও এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষমতাসীন মহাজোট বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র ও নাশকতা রুখতে দলীয় নেতা-কর্মীদের অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে বললেও কর্মীরা নির্বিকার। এমনকি যেসব এলাকায় জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে, সেসব এলাকায়ও ক্ষমতাসীন দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঢাকায় নেতারা ফটোসেশন করছেন। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ‘দেশ রক্ষা ও গণতন্ত্র রক্ষার’ সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। হেফাজতে ইসলাম মনে করে, দেশে এখন ইসলাম বিপন্ন, তাই তাদের মাঠে নামা জরুরি। কিন্তু আমরা এই সহজ কথাটি বুঝতে পারছি না যে দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ মুসলমান, সে দেশে কী করে ইসলাম বিপন্ন হয়? এখানে শত শত বছর ধরে ইসলাম চর্চা হয়ে আসছে। তাদের ধর্ম পালনে কেউ বাধাও দিচ্ছে না; বরং যারা এ দেশে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু, তাদের পাশে দাঁড়ানো কিংবা হেফাজত করার কেউ নেই।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ২৩টি সংগঠন গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে। তারা বলেছে, তারা শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করবে; কারও ওপর জবরদস্তি করা হবে না। অন্যদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ২২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি নিয়েছে। এর আগে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে অবিলম্বে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেছেন, আদালতে দলটির বিরুদ্ধে একটি মামলা থাকায় জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। অথচ কয়েক দিন আগে তিনি বলেছিলেন, ‘এ দেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করার অধিকার নেই।’
এই যে বিভিন্ন সংগঠন যুদ্ধংদেহী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে, তাতে সাধারণ মানুষ নিরুপায়, অসহায়। অর্থনীতির চাকা অচল। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা চলছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। এই হরতাল, অবরোধ, লংমার্চে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষ, যাদের কথা কেউ ভাবছে না।
জনমনে অধীর জিজ্ঞাসা—কী হবে আজ ৬ এপ্রিল এবং তার পর? দেশজুড়ে এখন টানটান উত্তেজনা। জনজীবনে অস্থিরতা। বাস, লঞ্চসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ আছে। লাগাতার কর্মসূচি সবাইকে গভীর সংকটে ফেলেছে। এই সংকট কি আজকের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শেষ হবে?
গতকাল বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে। মানুষ হতাহত হয়েছে। এই সংঘাত-সংঘর্ষের শেষ কোথায়? একটি অরাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে কেন এত অস্থিরতা? কেন এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সহ্য করতে পারছে না? ইসলাম তো শান্তির ধর্ম। সেই ধর্মের নামে কেন এই হানাহানি চলবে?
একাত্তরেও একদল মানুষ ধর্মের নামে অধর্মের কাজ করেছে। হেফাজতে ইসলামকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে, তাদের এই অরাজনৈতিক কর্মসূচিকে যাতে কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে। তরুণ প্রজন্মকেও শান্তি ও সংযম বজায় রাখতে হবে; তাদের এত দিনের সুনাম যাতে কারও উসকানিতে বিনষ্ট না হয়। সবার ওপরে দেশ। মানুষের মানবিক মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করুন। কেউ অন্যের কর্মসূচিতে বাধা দেবেন না। নিজ নিজ আদর্শ প্রচার করুন। কিন্তু অন্যকে আহত বা আক্রমণ করবেন না।
সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। হেফাজতে ইসলাম রোববার আগাম হরতালের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এরপর আরেক পক্ষ হরতাল ডাকবে। বিরোধীদলীয় নেতা বলে রেখেছেন, ‘হরতাল না চাইলে সরকারকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে।’ সরকার কার কাছে পদত্যাগ করবে? সরকার পদত্যাগ করলেই কি তিনি ক্ষমতায় আসতে পারবেন? ২০০১-০৬ সালেও এ ধরনের কঠোর ও কঠিন আন্দোলনে ছিল বিরোধী দল। তখন বিএনপির নেতারা বলতেন, ‘মেয়াদের এক দিন আগেও পদত্যাগ করবেন না।’
তাহলে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত দেশ অচল করার রাজনীতি চলতে থাকবে?
বিএনপির নেতারা নিশ্চয়ই আন্দোলন করছেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেশটা ধ্বংস হয়ে গেলে সেই ক্ষমতায় কী লাভ? তখন তাদেরও পূর্বসূরিদের মতো বলতে হবে, ‘বিগত সরকার দেশটা একেবারেই ধ্বংস করে গেছে। এখন এই ধ্বংস থেকে দেশকে পুনর্গঠনের জন্য অন্তত কয়েকটি মেয়াদে তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে।’
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক। sohrab03@dhaka.net
Leave a Reply