শীর্ষবিন্দু নিউজ: মুক্তিযুদ্ধের বড় ট্রাজেডি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদ মধ্যকার বিচ্ছেদের ঘটনা। এটার পর স্বাধীনতা বিরোধিতা সুকৌশলে তাদের প্রতিশোধ নেয়। আর এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ রচিত তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা এ কথা বলেন।
এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ জামান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিসহ দেশের বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, তাজউদ্দিন আহমদের বন্ধু ডা. এমএ করিম, সহোদর অ্যাডভোকেট আফছার উদ্দিন আহমদ, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ও ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হওয়া হাজী গোলাম মোরশেদ, মূলধারা ৭১ গ্রন্থের লেখক মঈদুল হাসান, তাজউদ্দিন আহমদের ছোট মেয়ে মাহজাবিন আহমদ, লেখিকার স্বামী আমর খাইরি আবদুল্লা ও গ্রন্থটির প্রকাশক ঐতিহ্যের প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাইম।
তাজউদ্দিন আহমদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার বিচ্ছেদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। তারা সুকৌশলে এটা করতে সক্ষম করে এর সুবিধাও নেয়। আর এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। গ্রন্থের ১৯৮ পৃষ্ঠায় লেখিকা বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ছিল আব্বু (তাজউদ্দিন আহমদ) ও মুজিব কাকুর (বঙ্গবন্ধু) বিচ্ছেদ। জাতির দুর্ভাগ্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেই ঘটে তাঁদের আদর্শিক ও নীতিগত বিচ্ছেদ। আব্বু ও মুজিব কাকু সারাজীবন যে নীতি ও আদর্শকে লালন করেছিলেন তারই সার্থক প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে। আব্বু তাঁর নীতি হতে দূরে সরে যাননি। কিন্তু মুজিব কাকু ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায় সরে গিয়েছিলেন বহু দূরে। সে কারণেই ঐ বিচ্ছেদ ঘটে।
গ্রন্থটির লেখক শারমিন আহমদ বলেন, মেয়ে হিসেবে বাবাকে নিয়ে লেখা ভীষণ কষ্টকর। কিন্তু, ইতিহাসকে তুলে আনার প্রয়াস ছিল। ভুলত্রুটি যা আছে, তা সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, পাঠ্যবই থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের আংশিক সত্য শেখানো হচ্ছে। টাকার সব নোটে তার (বঙ্গবন্ধু) ছবি। যারা তোষামোদী করে, তাদের কাছে টানা হচ্ছে। এসবই অনেকটা ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। বঙ্গবন্ধু স্বৈরতন্ত্রকে পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক। এ সবের কারণে অন্যরা বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে। লেখক শারমিন বলেন, ১৭ এপ্রিল ছিল মুজিবনগর দিবস। অথচ মুজিবনগর নামের স্রষ্টার নাম কোথাও উচ্চারিত হতে দেখা গেল না।
আলোচনাকালে ড. কামাল হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমদের ঐক্যে যারা ফাটল ধরিয়েছিল তারা এ দেশের ও স্বাধীনতার শত্রু। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের বিচ্ছেদ স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে সব থেকে বড় ট্রাজেডি এটা- গ্রন্থে এই যে কথা বলা হয়েছে, তা একশ ভাগ সঠিক কথা। এটা আমি এফিডেভিট করে লিখে দিয়ে যেতে চাই। তিনি গ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তরুণ প্রজন্মের সঠিক ইতিহাস জানার প্রয়োজন রয়েছে। ইতিহাসকে ধরেই একটা জাতি বাঁচতে পারে। তিনি বলেন, শারমিন যা লিখেছে, তরুণ প্রজন্মের জন্য এ ধরনের ইতিহাস লেখা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে কেউ ভুল করে থাকলে সেটাও ধরানো দরকার। সঠিক কাজ করে ভুল ধরানো যায়, তরুণ সমাজ মিলে এই কাজটা করবে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, এখানে কিছু কথা আছে যা বিতর্কের সৃষ্টি করবে। কারণ, একটা সময় থেকে ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখক বিষয়টাকে দেখেছেন। তবে তিনি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কাটানো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে বলেন, এই বইয়ে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও বাংলাদেশের মূল দর্শনের মিল আছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস উন্মোচিত হয়েছে।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন ও দর্শনের বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের মতপার্থক্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক মুক্ত দুনিয়ার অনুসারী। আর তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মস্কোপন্থি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছে। মানুষকে সত্য ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বই মানুষকে ইতিহাসের সেইসব মিথ্যা সম্পর্কে ‘ডিমোরালাইজড’ করতে সহায়তা করবে।
তাজউদ্দীনের ছোট ভাই আফসার উদ্দীন আহমদ, ঘনিষ্ঠ সহকারী মঈদুল হাসান, ছোট মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি, গ্রন্থের লেখক শারমিনের স্বামী আমর খাইরি আব্দুল্লা ও বইটির প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য’র প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাইম বক্তব্য রাখেন।