শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:১৬

নতুন শক্তি

 

 

 

 

 

 

 

 

সাযযাদ কাদির: দেশে আবির্ভাব ঘটেছে এক নতুন শক্তির। বিরোধে বিবাদে দ্বন্দ্বে সংঘাতে সহিংসতায় সংক্ষুব্ধ রাজনীতির আকাশে উদিত, উত্থিত হয়ে এ শক্তি এখন দেদীপ্যমান। এ উদয় আকস্মিক, অভাবনীয়। বিদ্যমান দুই পরাশক্তির কোলাহল ভেদ করে আরও এক পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে বলে ধারণা ছিল না কারও। কিন্তু সেই আবির্ভাব ঘটেছে সত্যি সত্যি। এ শক্তির নাম হেফাজতে ইসলাম। দেশের কোথায় কিভাবে সঞ্চিত ছিল এ শক্তি তা হয়তো অনুমান করা সম্ভব হবে না অনেকের পক্ষে। কিন্তু ছিল যে তা গতকাল এক বিশাল গণঅভ্যুদয়ের মাধ্যমে জানান দিয়েছেন তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তার জোটের ১৪ দল, বামপন্থি মহল, সুশীল বুদ্ধিজীবী এবং ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট মিলে এক শক্তি যখন দমন নির্যাতন শুরু করেছে অপর শক্তি বিরোধী বিএনপি, জামায়াত, তাদের জোটের ১৮ দলের ওপর তখন তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেখা দিলো হেফাজত ইসলাম। স্মরণকালের বৃহত্তম গণসমাবেশ, লংমার্চ, সাংগঠনিক শক্তি দেখিয়ে তারা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সরকারের প্রতি – সেই সঙ্গে বিদ্যমান অপরাজনীতির বিরুদ্ধেও। ঘুষ-দুর্নীতি, লুট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি সর্বস্ব দেউলিয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান এ এক আদর্শবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম। এদের স্লোগান অরাজনৈতিক। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান তারা। চান কঠোর আইন দ্বারা চরম শাস্তি। কোন দলের পক্ষে বা বিরুদ্ধে নয় তাদের ১৩ দফা দাবি। নষ্ট রাজনীতিতে আচ্ছন্ন সমাজে তারা চান ইসলামের সুমহান ভাবাদর্শে উজ্জীবিত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে। প্রচলিত রাজনীতিতে সেকুলার চিন্তা-চেতনার ধারক বাহকদের জন্য এটাই এখন হয়ে উঠেছে চরম গাত্রদাহ ও আতঙ্কের কারণ। তারা জানেন, হেফাজত ইসলামের অনড় অবস্থান ও লাগাতার কর্মসূচি ধস নামাতে পারে তাদের ক্ষমতার ভিতে। তাদের প্রতিষ্ঠায় ঘটাতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়। প্রশ্ন এখন, নতুন শক্তির কাছে কি আপস করবে কায়েমি শক্তি? নাকি লড়ে যেতে চাইবে সমানে সমানে – তা পরিণাম যা-ই হোক?

বাংলাদেশের রাজনীতি অভাবনীয়ভাবে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব অবশ্য নতুন নয়। ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯০, ২০০৬ সালে এমন আকস্মিক আত্মপ্রকাশ আমরা দেখেছি। তবে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান বাদে আর সবই সেনাঘটিত। সেদিক থেকে ২০১৩’র এই অভ্যুদয় শুধু বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র নয়, এর তাৎপর্যও ব্যাপক। কারণ হেফাজতে ইসলাম উত্থিত হয়েছে বিশাল বাংলার বুক থেকে। সেনানিবাস বা রাজধানীর রাজপথ থেকে উঠে আসা শক্তি নয় সে। তার শক্তিতে নিহিত আছে বৃহত্তর সামাজিক বিপ্লবের বিস্ফোরক। সে শক্তি বোঝা যায় পরোক্ষে প্রত্যক্ষে সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও সরকার যখন তাদের লংমার্চ ও সমাবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। আর এটাও বোঝা যায়, বাধা না দিলে কি হতে পারতো, কি ঘটতে পারতো গতকালের জনসমুদ্র রুদ্র রূপ ধারণ করলে। সেই ঘটনার আশঙ্কাই আজ কাঁপিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের, ক্ষমতার ভিত্তিমূলকে।

না, লড়াই শুরু হয় নি। রণক্ষেত্র হয় নি দেশ। দৃঢ় সংযম দেখিয়েছে দু’পক্ষই। তবে অবস্থান তাদের মুখোমুখি। এ অবস্থান থেকে হেফাজত একটুকুও সরে নি। সরকারও চাইছে না সরতে। দু’পক্ষকে আজ এভাবে দু’দিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের যুগ-যুগান্তের বৈষম্য ও বঞ্চনা। একদিকে ‘হ্যাভ’, আরেকদিকে ‘হ্যাভ নট’। একদিকে রাষ্ট্রের দুধ সর ক্ষীর খাওয়া আদরের সুপুত্র, আরেকদিকে ঘোল মাঠা খেয়ে কোন রকমে বেঁচে থাকা অবহেলিত সন্তান। একদিকে রাষ্ট্রের সকল সুযোগপ্রাপ্ত, সুবিধাভোগী, সর্বাধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় সুসভ্য, আলোকিত, সুশীল, বুদ্ধিজীবী, সেকুলার, অভিজাত এলিট। আরেকদিকে দারিদ্র্যলাঞ্ছিত বিত্তহীন শ্রমজীবী ভুখানাঙ্গা গরিব-গুরবো মানুষ। তাদের শ্রম ঘাম রক্ত শোষণ করে অর্জিত হয় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। তারা ধুঁকে ধুঁকে মরে মধ্যপ্রাচ্যে, বঙ্গোপসাগরে ভূমধ্যসাগরে, আফ্রিকার মরুভূমিতে, দক্ষিণ আমেরিকার বনে-জঙ্গলে। এক পক্ষের আছে হাসিনা, খালেদা, ইন্ডিয়া, আমেরিকা। আরেক পক্ষের কেউ নেই আল্লাহ ছাড়া। প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া এই তাদের সকল আশা-ভরসা তো এই একখানেই। সেখানেই এসেছে আঘাত। এ আঘাত এসেছে আসলে তাদের অস্তিত্বেই। সব কিছু সয়ে তারা যুগ যুগ ধরে মুখ বুজে রয়েছে নীরবেই। স্বাধীনতার পর কত জনের কত ভাগ্য বদলে গেল, কিন্তু তারা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। মাত্র বছর তিনেক আগে মুখ খুলেছিল হেফাজতে ইসলাম। সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ দেয়ায় এবং নারীনীতি ঘোষণার প্রতিবাদে উচ্চারিত হয়েছিল তারা। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম, বিচ্ছিন্ন ভাবে ঢাকায় সমাবেশ করেছে। শাহবাগ চত্বরের জাগরণ মঞ্চের নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়েছে তাদের কর্মসূচির মাসখানেক পরে, গত ৯ই মার্চ। জানিয়েছে দাবি-দাওয়া। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। শেষে সরকারের কার্যক্রমে হতাশ হয়ে নিয়েছে এই কর্মসূচি  যা গতকাল এক সুবিশাল জনবিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছে নতুন এক পরাশক্তিতে। মাত্র তিন বছরে গড়ে ওঠা এই শক্তি দেশের রাজনীতিকে সহসাই কোনদিকে ধাবিত করবে তা হয়তো অনুমানও করতে পারছেন না অনেককে। কিন্তু সকলেই জানেন তা নিশ্চিত ভাবে করবেই কোন এক দিকে।

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024