শীর্ষবিন্দু নিউজ ডেস্ক: বেহাত আসনগুলো নিজেদের কব্জায় আনতে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে এবার পশ্চিমবঙ্গে এক ঝাঁক তারকাকে বেছে নিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। ভোটের আর মাত্র দুইদিন বাকি থাকতে ভোটারদের মন পাওয়ার আশায় নিজেদের আসনগুলোতে ছুটোছুটি করে ব্যস্ত সময় কাটান এসব তারকারা।
আগামী ১২ মে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের ৪১ আসনে ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারতের নয় পর্বের লোকসভা নির্বাচন শেষ হবে। দুইদিন পর ১৬ মে নয়াদিল্লি থেকে একযোগে ফল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। রাজ্য থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় নিজেদের পাল্লা ভারী করে কেন্দ্রে যাওয়ার অভিযাত্রায় তৃণমূল নেতাদের আস্থার প্রতিদানে যেন মরিয়া তারকারা।
শুক্রবার সারা দিন মেদিনীপুরের ঘাটালের নির্বাচনী আসনে ঘুরে সেই চিত্র দেখা যায়, যেখানে তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন টালিউডের জনপ্রিয় তারকা দেব। তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় ৩৫টি আসন চায় তাদের দল। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে ক্ষমতার জটিল সমীকরণে দর কষাকষির সুযোগ পাবেন তারা।
এবার তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ১০ জন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে মনোনয়ন দিয়েছে। বাঁকুড়া থেকে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মেয়ে মুনমুন সেন, ঘাটাল থেকে টালিউডের নায়ক দেব (দীপক অধিকারী), মেহিনীপুর থেকে চিত্রনায়িকা সন্ধ্যা রায়, কৃষ্ণনগর থেকে অভিনেতা তাপস পাল, বীরভূম থেকে অভিনেত্রী শতাব্দী রায়, উত্তর মালদহ থেকে ব্যান্ড শিল্পী সৌমিত্র রায়, বালুরঘাট থেকে নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ এবং বহরমপুর থেকে সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেনকে মনোনয়ন দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির দল।
দুপুরে ঘাটালে গিয়ে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দেবের প্রচার-প্রচারণা। যেখানেই দেব সেখানেই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, জনজোয়ার। কখনো কাঁধে তুলে নিয়ে নাচছেন ভক্তরা, কখনো ভক্তদের পুষ্পবৃষ্টিতে সিক্ত প্রিয় অভিনেতা। স্থানীয় চা বিক্রেতা সনাতন সেতুয়া বলেন, প্রচার-প্রচারণায় সুপার স্টার দেব এগিয়ে থাকলেও এখানে তার সঙ্গে সিপিএম ও কংগ্রেস প্রার্থীর ত্রিমুখী লড়াই হবে। ভোটের হাওয়া কোন দিকে তা কেউ বলতে পারবে না। কলকাতা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের সাতটি থানা নিয়ে ঘাটাল আসন।
কংগ্রেসের হয়ে এখানে লড়ছেন মানস রঞ্জন ভুঁইয়া, যিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার বর্তমান বিধায়ক। তার ভোট চাইতে বৃহস্পতিবার ডেবরাতে প্রচারে আসেন রাহুল গান্ধী। বামফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত পশ্চিম মেদিনিপুর জেলার এই আসনে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন সন্তোষ রানা। আর বিজেপির প্রার্থী মুহাম্মদ আলম। লোকসভার তিনটি আসন- ঘাটাল, ঝাড়গ্রাম ও মেদিনীপুর নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জেলার তিনটি আসনেই জয়ী হয়েছিলেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা। এবার এই আসন তিনটি নিজেদের করে নিতে তারকাদের বেছে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
অবশ্য গতবার ঘাটালে বামফ্রন্টের শরিক সিপিআইয়ের পলিটব্যুরোর সদস্য গুরুদাস দাশগুপ্ত জিতলেও এবার তিনি নির্বাচনে নেই। সিপিআই মনোয়ন দিয়েছে সন্তোষ কুমারকে। ভোটের শেষ প্রচারণায় চলচ্চিত্রের ‘সুপার স্টার’ দেবকে দেখা যায় ব্যাপক উৎফুল্ল। ঘাটালের ডেবরার সড়ক পথ ধরে গ্রামের আকা-বাঁকা পথে কপললোচনঘাট, যেখানে দীর্ঘক্ষণ ধরে নায়ককে একনজর দেখার অপেক্ষায় গ্রামের গৃহবধূরা। টাটা কোম্পানির এসইউভি গাড়ি থেকে নেমেই দুই হাত তুলে গ্রামবাসীকে শুভেচ্ছা জানান দেব।
২৫ শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তিতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা ভালো থাকুন। আমি আপনাদের আশির্বাদ চাই। আবার দেখা হবে। এ সময় ‘বন্দে মাতরাম, দেবকে জয় হউক’- শ্লোগানে আন্দোলিত হয় চারপাশ। সবং গ্রামের অনিতা দেবী বলেন, প্রচারণা চালাতে গিয়ে রোদে দেবের শরীর কালো হয়ে গেছে। তিনি আগে যেরকম ফর্সা ছিলেন, আজ তা দেখা যাচ্ছে না। মেদিনীপুরে মাওবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নজির থাকায় দেবের জন্য থাকে বাড়তি নিরাপত্তা। দেবের পাশের মেদিনীপুর আসনে প্রার্থী হয়েছেন আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়।
নির্বাচন কমিশনের প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে থেকে দেখা যায়, ২০০৯ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ২৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯টিতে বিজয়ী হয়েছিল। ২০০৪ সালে তারা পেয়েছিল মাত্র একটি আসন। অপরদিকে লোকসভার গত নির্বাচনে সিপিএম রাজ্যে ৩২টি আসনের মধ্যে নয়টিতে এবং সিপিআই তিনটির মধ্যে দুটিতে বিজয়ী হয়ে লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব করে। ২০০৪ সালে সিপিএম ৩২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৬টি এবং সিপিআই তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জয়ী হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীপুর থেকে সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী এবং আসানসোল থেকে গায়ক বাবুল সুপ্রিয় এবং হাওড়া থেকে টালিউড তারকা জর্জ বেকার বিজেপির পদ্মফুল নিয়ে লড়ছেন। পশ্চিবঙ্গের বাইরে নয়াদিল্লি থেকে চিত্রনায়ক বিশ্বজিৎকে (টালিউড নায়ক প্রসেনজিতের বাবা) মনোনয়ন দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
লোকসভার গত দুটি নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বিজেপির ফলাফলের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০৯ সালে কংগ্রেস ১৪টি আসনে লড়াই করে মাত্র ৬টিতে এবং বিজেপি ৪২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র একটিতে বিজয়ী হয়েছিল। আর ২০০৪ সালের নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি একটি আসনও পায়নি। অপরদিকে কংগ্রেস ৩৭টির মধ্যে মাত্র ৬টিতে বিজয়ী হয়। তৃণমূল কংগ্রেস গত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আটটি আসনে লড়াই করে একটিতেও জয় পায়নি। আর সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে ৫০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র সাতটিতে এবং সিপিআই ৫৩টি আসনের মধ্যে মাত্র দুটিতে বিজয়ী হয়েছিল।
এসব পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজ্যে শক্ত অবস্থান না করতে পারায় কেন্দ্রে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে পশ্চিমবঙ্গের দলগুলো কোনো মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে এবারের দৃশ্যপট একটু ভিন্ন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত জনমত জরিপে কংগ্রেস ও বিজেপি কোনো দলেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি হওয়ায় আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব বেড়ে গেছে। ২০০৯ সালে ৫৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস বিভিন্ন রাজ্যে জোট শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে ৪৪০টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০৬টিতে বিজয়ী হয়। ওই নির্বাচনে বিজেপি ৪৪৩টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১১৬টিতে জয়ী হয়েছিল।