মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭

ঘুম ভাঙলো সিলেটের পুলিশ কমিশনারের: আলটিমেটামের পর ওসিদের প্রত্যাহার শুরু

ঘুম ভাঙলো সিলেটের পুলিশ কমিশনারের: আলটিমেটামের পর ওসিদের প্রত্যাহার শুরু

ওয়েছ খছরু: নানা ঘটনায় সিলেটে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝি। এ কারণে ওই সময় সিলেটে পুলিশের ইমেজ সঙ্কট দেখা দেয়। এ অবস্থায় স্থানীয় এমপি ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশে তাকে বদলি করে সিলেটে নতুন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মো. মিজানুর রহমানকে। নতুন কমিশনার সিলেটে যোগ দিয়েই আগের কমিশনারের দুর্নাম কিছুটা হলেও ঘোচানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু এরই মধ্যে সমপ্রতি সময়ে চলে এসেছেন আলোচনায়। ‘ওপেন হাউজ ডে’র আয়োজন এবং দীর্ঘ দিন পর সিলেট সম্পর্কে তার বোধোদয় নিয়ে সিলেটবাসী হতবাক হয়েছে। ওপেন হাউজ ডেতে কমিশনার মিজানুর রহমান নিজেই উপস্থিত থেকে সিলেটের তিন থানার ওসির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পেয়েছেন। আর এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি ওসিদের দিয়ে চলেছেন ‘আলটিমেটাম’। ইতিমধ্যে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি, দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি ও জালালাবাদ থানার ওসি পড়েছেন আলটিমেটামের ফাঁদে।

তবে, আলটিমেটাম দিয়েই শেষ নয়। অভিযুক্ত ওসিদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে অ্যাকশন। গতকাল সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি রঞ্জন সামন্তকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওপেন হাউজ ডেতে সিলেটের ভুক্তভোগী জনগণ কমিশনারের কাছে তুলে ধরে বিভিন্ন থানার অপরাধ কর্মকাণ্ডের চিত্র। আর এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড ও অপরাধীদের অবাধ দৌরাত্ব্যে মানুষ কতটা অসহায় সে বিষয়টি তিনি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে অনুধাবন করেন। তবে, ওপেন হাউজ ডেতে অভিযোগকারী অনেক ভুক্তভোগীই জানিয়েছেন, পুলিশ কমিশনারের কাছে প্রকাশ্য অভিযোগ করার আগে অনেক কিছুই লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। এর বাইরে সিলেটের কোতোয়ালি, দক্ষিণ সুরমা ও জালালাবাদ থানার অপরাধ কর্মকাণ্ড বিষয়ে কমিশনার নিজেও অবগত রয়েছেন। কিন্তু ওপেন হাউজ ডেতে গিয়ে তিনি ওসিদের ওপর সব দোষ ঝাড়েন।

সিলেটের কোতোয়ালি থানায় ওপেন হাউস ডেতে ভোক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, এ থানার এলাকায় প্রকাশ্য ঘটে ছিনতাই। খোদ থানার পার্শ্ববর্তী কিন ব্রিজ এলাকা ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া নগরীর আদালতের সামন, বন্দরবাজার, ধোপাদিঘীর পাড়, মেডিকেল এলাকা, শেখঘাট ও রিকাবীবাজার, মীরবক্সটুলা, মানিকপুর রোড, জেল রোড এলাকা সন্ধ্যার পরপরই ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যায়। এসব এলাকার পুলিশ ফাঁড়ি ও কোতোয়ালি থানার সাব ইন্সপেক্টর ও এএসআইরা অপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। ওপেন হাউজ ডেতে উঠে আসে মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কাজের অভিযোগ।

সিলেট নগরীর কাজিরবাজার, ঘাষিটুলা, মেডিকেল, বাগবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক ব্যবসা ও মাদকসেবীদের উৎপাত বেড়েছে বলে অভিযোগ জানানো হয়। এছাড়া সিলেটের ব্যস্ততম এলাকায় অবৈধ গাড়ি পার্কিং, হকারদের উৎপাত সম্পর্কেও অভিযোগ করা হয়। সিলেটের সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নানা পেশার মানুষের সামনে এসব অভিযোগ শোনার পর সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ হন পুলিশ কমিশনার। তিনি ওসিকে স্পষ্ট নির্দেশ দেন- ভাল কাজ করলে প্রশংসা পাবেন, অন্যথায় বিদায়। এরপর পুলিশ কমিশনার ওপেন হাউজ ডে করেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায়।

সিলেটের পাপরাজ্য বলে খ্যাত দক্ষিণ সুরমার অপরাধ কর্মকাণ্ডের কাহিনী আঁতকে ওঠার মতো। ভাসমান মানুষের এলাকা হওয়ায় দক্ষিণ সুরমায় এমন কোন অপরাধ নেই যা সংঘটিত হয় না। দক্ষিণ সুরমায় মাদক, পতিতাবৃত্তি, জুয়া ও ছিনতাইয়ের স্বর্গরাজ্য বলা চলে। থানার অধীনস্থ বিভিন্ন ফাঁড়ির সাব ইন্সপেক্টর ও সহকারী সাব ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে অপরাধী লালনের অভিযোগ অনেক আগের। দক্ষিণ সুরমা থানার অধিভুক্ত রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় অনেক দিন আগের মাদক স্পট। গেল সপ্তাহে ওপেন হাউস ডেতে এলাকার কাউন্সিলরসহ সচেতন নাগরিকরা অভিযোগ করেন, রেলওয়ে স্টেশন এলাকার কলোনিগুলো মাদকের নিরাপদ হাট। ইয়াবা, মদ, গাজাসহ বিভিন্ন রকমের মাদক এখানে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি ওই এলাকায় রয়েছে পতিতাদের হাটও। কীন ব্রিজের দক্ষিণ সুরমা অংশ থেকে সব ক’টি রুটে সন্ধ্যার পর থেকে পতিতাদের অবাধ চলাচল পরিবেশকে নষ্ট করে দিয়েছে। কলোনিগুলোতে শ’ শ’ পতিতা বাস করে বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। এছাড়া বেশ কয়েকটি জুয়ার আসর থেকে পুলিশ নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ করেন তারা। এসব অভিযোগ শোনার পর পুলিশ কমিশনার ওসি রঞ্জন সামন্তের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হন তিনি। তিনি রীতিমতো ক্ষেপে গিয়ে ওসিকে ধমকানও।

তিনি বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে দক্ষিণ সুরমার অপরাধ হাট উচ্ছেদ না করলে ওসিকে বিদায়। পুলিশ কমিশনারের আলটিমেটামের পর ওসি দক্ষিণ সুরমার অপরাধ রাজ্যে অভিযান চালান। কিন্তু ওই অভিযানে কমিশনার সন্তুষ্ট না হওয়ায় গতকাল ওসি রঞ্জন সামন্তকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর গত রোববার সিলেটের আরেক অপরাধপ্রবণ এলাকা জালালাবাদ থানায় ওপেন হাউজ ডে করেন পুলিশ কমিশনার। সিলেটের সবচেয়ে বড় মাদকহাট বাদাঘাট এলাকা। সন্ধ্যার পর জালালাবাদ থানার পাশের অংশ বাদাঘাট পুরোটাই চলে যায় মাদকসেবীদের নিয়ন্ত্রণে। সিলেট নগরীর মাদকসেবীরা বাদাঘাটকে মাদক ক্রয় ও সেবনের নিরাপদ আস্তানা মনে করেন। এ কারণে সন্ধ্যা নামলেই গাড়ি নিয়ে মাদকসেবীরা ছুটে যায় বাদাঘাটে। জালালাবাদ থানা গঠনের আগে থেকে এখানে মাদকের হাট হলেও থানা গঠনের পর থেকে এখানে মাদক বিকিকিনি আরও বেড়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, থানার পুলিশের কোন কোন সাব ইন্সপেক্টর ও এএসআই ওই হাটের শেল্টার দেন। ওপেন হাউজ ডেতে পুলিশ কমিশনারের কাছে এসব অভিযোগ জানানোর পর কমিশনার মিজানুর রহমান ওসি গৌছুল আলমের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এক মাসের মধ্যে মাদকের হাট উচ্ছেদ করতে না পারলে ওসিকে বিদায় নিতে হবে বলে আলটিমেটাম দেন। সিলেটের বিমানবন্দর থানায় ওপেন হাউস ডেতে কমিশনার উপস্থিত না থাকলেও অতিরিক্ত কমিশনার রোকনউদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তিনিও কমিশনারের মতো বিমানবন্দর থানার ওসিকে অপরাধ দমনে আলটিমেটাম দিয়ে এসেছেন। সিলেটে ইতিমধ্যে যে চারটি থানায় ওপেন হাউজ ডে হয়েছে সবগুলোতে ওসিদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন কমিশনার। আর তাদের আলটিমেটামও দেয়া হয়। তবে, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি একটুও। আগের মতোই সবকিছু চলছে।

দু’জন ওসি জানান, থানা পুলিশ সামর্থ্য মতো চেষ্টা করছে। কমিশনারের আলটিমেটামের পর তারা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনেক স্থানেই তারা রাজনৈতিক কারণে আটকে আছেন। এদিকে, ওপেন হাউজ ডে আয়োজন নিয়ে থানায় থানায় পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। বিমানবন্দর ও জালালাবাদ থানার নিয়ন্ত্রিত এলাকার দুজন ইউপি সদস্য মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ওপেন হাউজ ডে আয়োজন করতে পুলিশ তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। এভাবে বিভিন্ন অপরাধ হাট থেকে টাকা নিয়ে জাঁকঝমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হচ্ছে ওপেন হাউজ ডে’র। তবে, চাঁদাবাজির বিষয়টি ওসিরা অভিযোগ করেছেন।

ওসি রঞ্জন সামন্ত প্রত্যাহার: ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মাদকের চিহ্নিত আস্তানাগুলো উচ্ছেদ করতে না পারায় দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি রঞ্জন সামন্তকে প্রত্যাহার করেছেন পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমান। গতকাল বুধবার সকালে প্রত্যাহারের এ আদেশ পাঠানো হয় থানায়। মোগলবাজার থানার ওসি মুরসালিনকে দক্ষিণ সুরমা থানার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওসি প্রত্যাহার ও যোগদানের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. রহমত উল্লাহ। গত ২৪শে মে দক্ষিণ সুরমা থানায় ‘ওপেন হাউজ ডে’ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন মাদক স্পটের বর্ণনা দিয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুধীসমাজ।

ওই অনুষ্ঠানে ২৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌফিক বকস লিপন অতীতে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বারবার পুলিশের কাছে ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার কথা জানান পুলিশ কমিশনারকে। পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় দক্ষিণ সুরমার অন্তত ১০টি স্থানে পাইকারী ও খুচরা মাদক বিক্রি হয় এমন অভিযোগও করেন কাউন্সিলর। বক্তব্য শুনে ওসির উপর খেপে গিয়ে ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন কমিশনার। ওই সময়ের মধ্যে মাদকের আস্তানা উচ্ছেদ করতে না পারলে ওসিকে ক্লোজড করার ঘোষণা দেন তিনি। পুলিশ কমিশনারের বেঁধে দেয়া সময় মঙ্গলবার পার হলেও দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি রঞ্জন সামন্ত মাদকের আস্তানা উচ্ছেদে ব্যর্থ হন। চিহ্নিত আস্তানাগুলোতে তিনি কোন অভিযানও করেননি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় লোকজন। গত সোমবার রাতে তিনি রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন ভাসমান পতিতা ও মাদকসেবী আটক করেন। এই অভিযানকেই বড় সাফল্য হিসেবে দাবি ওসির। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, কমিশনার জনগণকে দেয়া তার কথা রেখেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় ওসি রঞ্জন সামন্তকে দক্ষিণ সুরমা থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024