লায়েকুজ্জামান: ঝুলে গেল পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার তদন্ত কাজ। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কানাডা সরকারের এমএলআর না দেয়া এবং বিচারের শুনানিতে অংশ নিতে দুদক কর্মকর্তাদের কানাডা যাওয়ার ভিসা না দেয়ায় পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার তদন্ত কাজে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে বলে দুদক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে সংস্থাটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জানিয়েছেন, কর্মকর্তাদের কানাডা যেতে না পারায় তদন্তকাজে কোন প্রভাব ফেলবে না। তবে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কানাডার সরকার ও আদালতের সহযোগিতা না পেলে দুর্নীতির তদন্তের কিনারা করা সম্ভব হবে না।
পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগের উৎস স্থল কানাডা। কানাডার রয়েল পুলিশের কাছ থেকে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগটি পায় বিশ্বব্যাংক। ওই অভিযোগই একই সঙ্গে দুদক ও বাংলাদেশ সরকারকে জানায় বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ইসমাইল হোসেনের ল্যাপটপ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক রমেশ সাহার ডায়েরি জব্দ করে কানাডিয়ান রয়েল পুলিশ। অভিযোগ ওঠে পদ্মা সেতুর কাজ পেতে বাংলাদেশে ঘুষ দিতে হবে এমন ব্যক্তিদের নামের একটি তালিকা পাওয়া যায় রমেশ সাহার ডায়েরিতে। ইসমাইল হোসেনের ল্যাপটপে পাওয়া যায় একই বিষয়ে বাংলাদেশী কয়েকজন ক্ষমতাধর নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ। ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কানাডিয়ান রয়েল পুলিশ সেখানকার আদালতে একটি মামলা দায়ের করে ইসমাইল ও রমেশ সাহার নামে। বর্তমানে কানাডার আদালতে ওই মামলার শুনানি চলছে। ১৪ই এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া শুনানি চলবে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত। ইতিপূর্বে অনেকবার দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার পরিপূর্ণ তদন্ত করতে হলে কানাডা সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। রমেশ সাহার ডায়েরি হাতে পাওয়া দরকার এবং কানাডার আদালতে দেয়া তাদের বক্তব্যও প্রয়োজন। রমেশ সাহার ডায়েরি সহ অভিযোগের ডকুমেন্ট পেতে দুদক ইতিপূর্বে কানাডা সরকারের কাছে এমএলআর (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল রিকয়েস্ট) পাঠালেও কানাডা সরকার তার কোন জবাবই দেয়নি। সর্বশেষ দুদক কানাডা আদালতে ওই মামলার শুনানি পর্যবেক্ষণের জন্য দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক এবং দুদক কর্মকর্তা মির্জা জাহিদুল ইসলামকে কানাডা পাঠানোর জন্য ভিসার আবেদন করলে কানাডা সরকার ভিসার আবেদনও নাকচ করে দেয়। ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে কানাডা থেকে পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার কোন ডকুমেন্ট পাওয়ার পথ প্রায় চূড়ান্ত ভাবে বন্ধ হয়ে গেলো।
পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রাক যাচাইতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করা হয় পরামর্শক প্রাক যাচাই প্রক্রিয়ার দুর্নীতির অভিযোগ। দুদক উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল ইসলাম ছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এ অভিযোগের বিষয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, জাতীয় সংসদের এক হুইপের ছোট ভাই নিক্সন চৌধুরী, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, চার প্রকৌশলী, এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হক, গোলাম মোস্তফা এবং অপর চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের ১২ প্রতিনিধিসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একই বিষয়ে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গেও আলাপ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। জুলাই মাসের ২৩ থেকে ২৫ তারিখ বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে দুদককে তিন সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক মানের প্যানেলকে দুদকের কাজে পর্যবেক্ষণ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু দুদক সেই প্রস্তাবে তখন রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি ছিল এতে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দুদকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। এমন অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে চলতি বছরের জুন মাসের ২৯ তারিখ পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আবারও ঋণ দিতে সম্মত হলেও দুর্নীতির তদন্ত অধিকতর জোরদার করার দাবিটি আগের মতোই রেখেছে। পরে নানা দেন-দরবারের পর সরকারের পক্ষ থেকে সংস্থাটির দেয়া চার শর্ত মেনে নেয়ায় আবার ২০শে সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। শর্তানুযায়ী ৫ই অক্টোবর পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঘোষণা করে বিশ্বব্যাংক। ওয়াশিংটনে অবস্থিত সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের এ প্যানেল ঘোষণা করা হয়। পরদিন ৬ই অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিস। প্যানেলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল ওকাম্পো। যিনি আইসিসি’র হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে কাজ করতেন। অপর দুই সদস্য হলেন, হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান।
বিশেষজ্ঞ দল দুদকের অনুসন্ধান কাজ পর্যবেক্ষণ করতে ১৪ই অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় আসেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী লুইস গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল দুদকের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করে ১৬ তারিখ ঢাকা ত্যাগ করেন।
২০০৯ সালে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যে গত ২৮শে এপ্রিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া, অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে গত ১৮ই মে জাপানের সঙ্গে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান বিষয়ক চুক্তি করে সরকার। গত ২৪শে মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গত ৬ই জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ৪৪৮৯ কোটি টাকা (৬১৫ মিলিয়ন ডলার) ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
প্রাক যাচাইতে থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কানাডার এসএনসি লাভালিন, যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একম অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি হাইপয়েন্টরেলেন্ড।
গত বছর ১৭ই ডিসেম্বর ৭ জনকে আসামি করে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়। এজাহারে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর নাম থাকলেও তাদেরকে মামলার আসামি করা হয়নি। সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলার আসামি না করায় নাখোশ হয়ে বিদায় নেন বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দল। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। বিশ্বব্যাংক অধ্যায়ের শেষ হলেও দুদক বলেছিলো তারা পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার তদন্ত চালিয়ে যাবে। কিন্তু কানাডা থেকে কোন ডকুমেন্ট না পাওয়ায় বাস্তবে চূড়ান্ত ভাবে ঝুলে যাচ্ছে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার তদন্ত।
এবিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আমাদের প্রতিনিধিরা কানাডা যেতে পারেনি এতে কিছু যায় আসে না, এতে মামলার তদন্তের কোন ক্ষতি হবে না। এছাড়া, বর্তমানে কানাডার আদালতে যে শুননি চলছে এটা চূড়ান্ত শুনানি নয়, এটা প্রাথমিক শুনানি। চূড়ান্ত শুনানির সময় সেখানে আমাদের লোক যাবে।
Leave a Reply