আসাদ জামান: ফুরফুরে মেজাজে আছে আওয়ামী লীগ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বড় কোন চ্যালেঞ্জ ছাড়াই মাস ছয়েক সময় পার করে এখন আরো আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনার সরকার। অন্যদিকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আছে অস্বস্তি আর হতাশায়। রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মতে, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা এগিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগকে। অপরদিকে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা বিএনপিকে ঠেলে দিয়েছে ব্যাকফুটে।
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপিহীন নির্বাচনে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও শঙ্কা কাজ করছিল। নানামুখী অভ্যন্তরীণ চাপ ও সমালোচনায় দলটির হাইকমান্ড ছিলো চিন্তত। ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের উপুর্যপরি কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভূত দিক নির্দেশনা কিছুটা দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল সরকারকে। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলও শঙ্কার জন্ম দিয়েছিল আওয়ামী লীগে।
কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সময়পোযোগী উদ্যোগ ও সেগুলোর বাস্তবায়ন আওয়ামী শিবিরে স্বস্তি এনে দিয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা। ফলে নির্বাচনের ৬ মাস পরে এসে ফুরফুরে মেজাজে আছে তারা। অপরদিকে নির্বাচনের পর ৬ মাস পার হয়ে গেলেও সরকারকে চাপে রাখার মতো কোনো কর্মসূচি বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি।
দলীয় সূত্রমতে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি না দিয়ে দল গোছানোর দিকে মনোযোগ দেয় বিএনপি। পশাপাশি ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দিকে রাখে সতর্ক দৃষ্টি। দেশটির কংগ্রেস সরকারের একক সমর্থনের কারণেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হয়নি বলে মনে করে দলটির হাইকমান্ড।
এক্ষেত্রে লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীল কংগ্রেসের জায়গায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা হলেও চাপে থাকবে বলেই মনে করছিলো বাংলাদেশের অন্যতম ধর্মীয় জাতীয়বাদী দল বিএনপি। সে কারণেই ১৬ মে লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো।
এদিকে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তার প্রথম একক বিদেশ সফরেই (মোদীর সঙ্গে ভুটান গেলেও সেটি তার নিজস্ব সফর ছিল না) বাংলাদেশকে বেছে নেন। সূত্র জানায়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর স্বরাজের সঙ্গে খালেদার বৈঠকের সুযোগ চেয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে জোর তদবির চালানো হয়।
কিন্তু গত ২১ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিএনপির চেয়ারপার্সনকে বাদ দিয়েই সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরসূচি চূড়ান্ত করে। ওই সময় ভারতের সংবাদমাধ্যম জানায়, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সম্মানের কথা চিন্তা করেই সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসূচিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি রাখা হয়নি।
সদ্য ক্ষমতায় আসা বিজেপি জাতীয় স্বার্থ ও সম্মানের কথা চিন্তা করে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতা প্রণব মুখার্জির সম্মান রক্ষায় এমন অবস্থান নেওয়ায় স্বপ্নভঙ্গ হয় বিএনপির। শেষ পর্যন্ত সুষমার সাক্ষাৎ পেলেও পুরো প্রক্রিয়া যেভাবে সম্পন্ন হয় তা বিএনপির মতো দলের জন্য অস্বস্তিদায়কই বটে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাই শেষ পর্যন্ত সুষমার সঙ্গে তার হোটেলে গিয়ে সাক্ষাত করে মুখরক্ষার চেষ্টা চালান। যদিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১২ মিনিটের ওই সৌজন্য সাক্ষাৎকে ‘যান্ত্রিক’ আখ্যা দেওয়ায় আরও বেশি অস্বস্তিতে পড়েন বিএনপি প্রধান।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করা বিজেপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তার সফরে শেখ হাসিনার হাতে নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিয়ে তার (শেখ হাসিনা) আন্তরিকতার ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। ফলে কংগ্রেসের জায়াগায় বিজেপি আসিন হওয়ায় আওয়ামী লীগের মধ্যে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল তা অনেকটাই দূর হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের নতুন সরকারের ইতিবাচক মনোভাব, পুরনো ও পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার অব্যাহত সমর্থন এবং প্রধানমন্ত্রীর চীন-জাপান সফরের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হওয়ায় সরকার অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। শুধু বিদেশ নীতিতে নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগের ‘নুয়ে পড়া পালে হাওয়া লেগেছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
সম্প্রতি এক বিক্ষোভ সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মাসেতু করতে না পারায় আমাদের কম কথা শুনতে হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমরা পদ্মাসেতু করছি। এখন আমাদের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। যদি নিজেদের ক্ষতি নিজেরা না করি।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, পদ্মাসেতুর ওয়ার্ক অর্ডার, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে ৫ জানুয়ারির ক্ষত অনেকটাই সারিয়ে তুলেছেন তারা।
তাছাড়া বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ ৭ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামিসহ ওই ঘটনায় জড়িত বিশেষ বাহিনীর তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় এনে এবং ফেনি হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ সন্দেহভাজনকে পাকড়াও করে হঠাৎ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে সরকার। দলটির নেতারা মনে করছেন, এমন সব পদক্ষেপ ব্যাকফুটে যাওয়া আওয়ামী লীগকে আবার ফ্রন্টফুটে নিয়ে এসেছে। এটি ধরে রাখতে পারলে বিরোধী পক্ষের আগাম নির্বাচনের দাবি হালে পানি পাবে না।
এদিকে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিভিন্ন ইস্যুতে একাধিকবার ঢাকায় জনসভা করতে চাইলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেনি বিএনপি। ঢাকার বাইরে দু’টি জনসভার সুযোগ পেলেও সময় স্বল্পতা এবং প্রতিকুল আবহাওয়ার কারণে তাও জমাতে সক্ষম হয়নি তারা।
সূত্র জানায়, সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে একদিকে যেমন আন্দোলন জমাতে পারেনি বিএনপি অন্যদিকে ভুলনীতির কারণে মিত্র বাড়ানোর মিশনেও অনেকটা হোঁচট খেয়েছে। সর্বশেষ রাজনীতিবিদদের সম্মানে আয়োজিত খালেদা জিয়ার ইফতার মাহফিলে বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর অনুপস্থিতি অস্বস্তিতে ফেলে দেয় বিএনপিকে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না উপস্থিত হলেও মঞ্চে না ওঠার বিষয়টি বিএনপির জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না মোটেও। তবে এসব বিষয়ে একদমই কথা বলতে নারাজ বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
বৃহস্পতিরবার দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বিষয়ে একটি কথাও বলতে পারব না। যা কিছু জানার সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন। একই কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এমকে আনোয়ার। তবে একাধিকার ফোন দিয়েও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।