মনজুর আহমেদ ও অনিকা ফারজানা: নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিপুল অঙ্কের ঋণদায় তৈরি করেছে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়। এর প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ম অনুসারে খেলাপি হওয়ার কথা। কিন্তু অনেকটাই গোপন করে ভালো মানের দেখিয়ে চলেছে ব্যাংক। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও শাখার কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই অনিয়মগুলো হয়।
আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা ফন্দিফিকির আর অনিয়ম করে ব্যাংকের এই অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পরিদর্শনে অনিয়ম ও যোগসাজশের প্রমাণ মিললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও হল-মার্ক কেলেঙ্কারির মামলায় আসামি হুমায়ুন কবীরের নাম রয়েছে। একাধিক সাবেক ডিএমডি ও মহাব্যবস্থাপকদের নামও রয়েছে তালিকায়। অন্যদিকে অনিয়ম-জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ সবই থাকার পরও গ্রাহককে নতুন সুবিধা দেওয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে।
প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে এই পরিদর্শনকাজও একসময় আটকে রাখা হয়েছিল। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে পরিদর্শনকাজ শেষ হলেও এখনো কোনো অফিস আদেশ দেয়নি প্রধান কার্যালয়। অথচ সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখার আগে (গত বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় শাখার পরিদর্শনকাজ শুরু হয়েছিল। বিষয়টি এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানের তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে সোনালী ব্যাংকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে বহুল আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারিও রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকার মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচতলায় অবস্থিত স্থানীয় কার্যালয় দেশের সবচেয়ে বড় শাখা ব্যাংক। শাখাটিতে যে সীমাতিরিক্ত ঋণদায় তৈরি হয়, তাতে সরাসরি এমডি ও ডিএমডি যুক্ত থাকেন, অনুমোদন করেন। এমডি বা ডিএমডির মন্তব্য বা সুপারিশে প্রথমে নন-ফান্ডেড বা এলসি জাতীয় ঋণদায় হয়, পরে তা পুরো ঋণে পরিণত হয়।
যোগাযোগ করা হলে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, আগের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বেশকিছু অনিয়মের কথা বলা হয়েছিল। নতুনভাবে পরিদর্শন করানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘গত ডিসেম্বরভিত্তিক প্রতিবেদনটি খুব শিগগিরই আমার হাতে আসবে। সেটা দেখে কোনো অনিয়ম থাকলে, কী ধরনের অনিয়ম, কাদের বিরুদ্ধে কী তথ্য মিলেছে, সে ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঋণপত্রে জালিয়াতি: ব্যাংক সূত্রগুলো জানায়, স্থানীয় শাখায় নিয়মনীতি ভেঙে বিপুল পরিমাণ অনিয়মিত ঋণ থাকা সত্ত্বেও ক্যাশ এলসি (নগদ অর্থের ঋণপত্র) বা ডেফার্ড ক্যাশ এলসি খোলা হয়েছে। অর্থ পরিশোধ না হলেও ঋণটিকে নিয়মিতই দেখা হয়েছে মাসের পর মাস। পরে সেগুলোর বিপরীতে লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (বিশ্বাসের ওপর ঋণ বা এলটিআর) এবং পেমেন্ট এগেইনেস্ট ডকুমেন্ট (বিদেশি রপ্তানিকারকদের পাঠানো কাগজপত্রের ভিত্তিতে বা পিএডি) ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এসব ঋণের বিপরীতে জামানত বা মর্টগেজ তেমন কিছুই নেই। আবার মালামাল ব্যাংকের কাছে এমনকি গ্রাহকের কাছেও নেই। অনেক আগেই তা বিক্রি হয়ে গেছে। অথচ বিদেশি ব্যাংককে অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। ফলে শুধু এলটিআর ঋণের ক্ষেত্রেই এক হাজার ৪০৮ কোটি টাকা এবং পিএডি ঋণে ১৩৫ কোটি টাকার ঋণ আদায়ের কোনো অবস্থা নেই। ব্যাংকের বিভাগীয় তদন্তে দেখা গেছে, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, কে এন এস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ক্যাং সান ইন্ডাস্ট্রিজ, থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস ও অলটেক্স ফেব্রিকসকে এলটিআর সুবিধা দিতে বিধিবিধান একেবারেই মানা হয়নি।
ভুয়া রপ্তানিপত্র: ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভুয়া রপ্তানিপত্র বা চুক্তিপত্রের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা ও তার বিপরীতে অভ্যন্তরীণভাবে স্বীকৃতিপত্র বা আইবিপি তৈরি করে বের করে নেওয়া হয়েছে অর্থ। পরে আবার তার বিপরীতে ‘ফোর্সড’ ঋণ তৈরি করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে ব্যাংকের পরিদর্শন দল। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬০০ কোটি টাকার ফোর্সড ঋণ তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০১ কোটি টাকা বিরূপভাবে শ্রেণীকৃত বা খেলাপি ঋণ হয়েছে।
ব্যাংকের নিজস্ব তদন্ত অনুসারে, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ কিছু এলসির বিপরীতে অ্যাকোমুডেশন বিল বানিয়ে ২০১০ সালে ৩৪ কোটি টাকা এবং ২০১১ সালে ৯২ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়। পরে তা ফোর্সড ঋণে পরিণত করা হয়। এ ক্ষেত্রে অলটেক্সের দুটি কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও অলটেক্স ফেব্রিকসের মধ্যে স্থানীয় এলসি দিয়ে লেনদেন দেখানো হয়েছে। অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ এলসি দিয়েছে, তার বিপরীতে ফেব্রিকস কাপড় সরবরাহে দামসহ প্রস্তাব দিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি এতে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা তখন স্বীকৃতি বিল। ব্যাংক এই বিল কিনে নিয়ে (৮০-৯০ ভাগ) অর্থ পরিশোধ করেছে ফেব্রিকসকে। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রি সেই অর্থ পরিশোধ করেনি। পরে এই দায় মেটাতে ব্যাংক একটি ঋণ সৃষ্টি করেছে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে, যাকে বলা হচ্ছে ফোর্সড লোন বা ডিমান্ড লোন।
সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শনে তথ্য মিলেছে, অনেক ক্ষেত্রে কোনো কাপড় লেনদেন হয়নি। শুধু ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র দেওয়া-নেওয়া করে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। আবার এমন হয়েছে যে কিছু ক্ষেত্রে ফেব্রিকস কাপড় দিয়েছে এবং সেই কাপড় রপ্তানিও হয়েছে। অর্থ বিদেশ থেকে প্রত্যাবাসনও হয়েছে। সেই টাকা ব্যাংকের কাছে এসে জমা (সানড্রি হিসাব) হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে গ্রাহকের কাপড় কেনার অর্থ পরিশোধ করেনি অলটেক্স ইন্ডাস্টি। সেই টাকায় ইন্ডাস্টির অন্য দায় (ক্রস পেমেন্ট) মেটানো হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নগদ উত্তোলনের জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে অলটেক্স ইন্ডাস্টির চলতি হিসাবে। পরে দায় মেটাতে ব্যাংক দেখিয়েছে ফোর্সড বা ডিমান্ড ঋণ।
একই প্রক্রিয়ায় পদ্মা পলিকটন নিট ফেব্রিকস লিমিটেডের ২০০৮ সালে ৩৬ কোটি টাকা এবং ২০১০ সালে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার ফোর্সড ঋণ তৈরি হয়। ২০১১ সালে কোম্পানির ২৯৮টি ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে ২০১২ সালে এসে ৪৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকার ডিমান্ড ঋণ তৈরি করা হয়। এপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলসকে তিন বছরে (২০০৯-১২) মোট ৭৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকার দেওয়া ঋণ ইতিমধ্যে শ্রেণীকৃত বা খেলাপি চিহ্নিত হয়েছে।
অন্যদিকে ভুয়া রপ্তানি এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক সুবিধা দিয়ে প্রিলুসিট নামের এক কোম্পানিকে ২০০৮ সালে সাত কোটি টাকা এবং ২০১০ সালে আট কোটি টাকার দায় তৈরি করা হয়। পরে তা ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু এই ঋণ আদায় না হওয়ায় এখন তা খেলাপি হয়েছে।
নগদ সহায়তা জালিয়াতি: নিয়ম ভেঙে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরকারের দেওয়া রপ্তানি উন্নয়নে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দুই বছরে বিভিন্ন গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ রপ্তানি বিলের আংশিক বা সম্পূর্ণ মূল্য প্রত্যাবাসন না হলেও তাদের ২০ কোটি টাকার নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। একই সময় রপ্তানির ডিসকাউন্ট বিল কিনতে বিনিময় হারেও নানা ধরনের ফন্দি করা হয়েছে। ডিসকাউন্ট বিলের বিনিময় হার না মেনে সাইট এলসির বিনিময় হারে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ১০ কোটি টাকা।
Leave a Reply