সাজেদুল হক: আপনি কি মেয়েটির ছবি দেখেছেন? তার মুখ দেখা যায় না। শরীরের অন্য কোন অংশও নয়। শুধু দেখা যায় একটি পা। যে পায়ে কঙ্কন বাঁধা। মেয়েটি কার দিকে তাক করে রেখেছে তার পা? আমার দিকে, আপনার দিকে?
সভ্যতার মুখোশ সেলাই করতো ওরা। ওরা কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই কেউবা বোন। ওরা আটকে পড়েছে রানা প্লাজা নামে এক মৃত্যুপুরীতে। একদিন আগেও ওদের নাম ছিল। কারও নাম আসমা, কারও নাসিমা, কারও জয়নাল। এখন ওদের নতুন নাম হয়েছে ‘লাশ’।
ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাবান এক নেতা সোহেল রানা। সাভার বাসস্ট্যান্ডে তার ক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৯তলা ভবনটি। পাঁচটি গার্মেন্ট আর একটি বেসরকারি ব্যাংক ছিল ওই ভবনে। মঙ্গলবার ভবনটিতে ফাটলের খবর পরদিন ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। ভবনে থাকা বেসরকারি ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ডলারের হিসাব আর বিশ্ব বাণিজ্যে যারা বড় বেশি প্রয়োজনীয়, তাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। লোভী মালিকরা তাদের বাধ্য করেন কাজে যোগ দিতে। যে মেয়ে সকালে তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিল, যে মা তার সন্তানকে রেখে এসেছিলেন বাসায়; তারা কেউ কি জানতেন এই তাদের শেষ দেখা। বুধবার সকালে মুহূর্তের মধ্যে ধসে পড়ে ভবনটি। মানুষের আর্তনাদ আর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আকুতিতে ভারি হয়ে ওঠে সাভারের বাতাস। উদ্ধার কাজে এগিয়ে আসেন হাজার হাজার মানুষ। চিকিৎসা দিতে এগিয়ে আসে হাসপাতাল। কিন্তু কত? একে একে বের হতে থাকেন মানুষ। কেউ জীবিত। কেউবা নতুন নামে। বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন স্বজনেরা। একটিবারের মতো স্বামীকে ফিরে পেতে চান স্ত্রী। বলছেন, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাওয়াবেন স্বামীকে। মায়ের জন্য সন্তানের আহাজারি। মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন পিতা? প্রিয় মানুষের ফোনটি একবার বেজে উঠুক এই তাদের প্রার্থনা। কেউ ছোটেন হাসপাতালে, কেউবা লাশের খোঁজে। প্রিয়জনের লাশ পেলেও যেন কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন তারা। আবারও কোন কোন লাশও কি স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছে না? মানুষ বসে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায়- এর চেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য আর কি হতে পারে? টিভি চ্যানেলের লাইভ সমপ্রচারে এসব দৃশ্য দেখে চোখের পানি সামলাতে পেরেছেন খুব কম মানুষই। বিশ্ব মিডিয়ায় আবারও সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন আমাদের সেলাই মেয়েরা।
বাতাসে লাশের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ। আপাতত ক্যালকুলেটরে নানা হিসাব চলবে, সরকারি-বেসরকারি। কেউ বলবেন মৃতের সংখ্যা এত, কেউ বলবেন না অত। কয়েকদিন শোরগোল চলবে। কিছু নিষ্ঠুর কৌতুক করবেন ক্ষমতাবানরা। যেমনটা করেছেন আমাদের এক মাননীয় মন্ত্রী। জাতীয় শোকদিবস পালন হবে। নিজেদের অক্ষমতা আমরা চাপিয়ে দেবো জাতীয় পতাকার ওপর। কিন্তু এরপর কি? গার্মেন্ট মালিকরা কি গ্রেপ্তার হবেন? গ্রেপ্তার হবেন ভবন মালিক? তাদের কি কোন শাস্তি হবে? শেষ পর্যন্ত আসলে কিছুই হবে না। যেমন হয়নি সেপকট্রাম ট্রাজেডিতে, যেমন হয়নি তাজরিন ট্রাজেডিতে। সংবাদপত্রের পাতায় টিভি টকশোতে কয়েক দিন আলোচনার ঝড় উঠবে। বড় বড় বক্তৃতা দেবেন বিজিএমইএ নেতারা। কিভাবে তারা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন সে বয়ান করে যাবেন। নেতা-নেত্রীরা খেলবেন দোষারোপের খেলা। সাংবাদিকরা ভুলে যাবেন গণহত্যার শিকার হওয়া এসব মানুষদের। নতুন কোন ট্রাজেডি নিয়ে নতুন করে এলিজি লিখবো আমরা। আর কিছু না।
এক পা উদ্ধত মেয়েটির কথা এ পর্যন্ত এসে আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। তাকে নিয়েই অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘তোমার কঙ্কনের ধ্বনি বেজেছে মায়ের আঙিনায়, তোমার সংসারে তোমার উর্ধ্বমুখী হাত উঠেছে প্রার্থনায় সে গতকাল ছিল
…
আগামীকাল তোমার কঙ্কনের ধ্বনি বাজবে না মায়ের আঙিনায়, তোমার সংসারে এখন তোমার পা উদ্ধত বাংলাদেশের দিকে।’
Leave a Reply