নূরুজ্জামান/হাফিজ উদ্দিন, সাভার থেকে: দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শ’ শ’ নারী-পুরুষ। হাতে হাতে ছোট-বড় ছবি, পরিচয়পত্র। চেয়ার-টেবিলে বসা পুলিশ সদস্যদের দিকে এগোচ্ছেন তারা। চারদিকে সেনা ও বিজিবি কর্মকর্তাদের পাহারা। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সাদা-কালো ও রঙিন ছবির পোস্টার। প্রথম দেখায় মনে হবে এ যেন কোন ভোটকেন্দ্রের দৃশ্য। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হয় না, যখন চোখ আটকে যায় ওইসব পোস্টারের দিকে। প্রত্যেক ছবির উপর লেখা ‘সন্ধান চাই’- ফিরে পেতে চাই বুকের মানিককে। অন্যদিকে লাইনে দাঁড়ানো নারী-পুরুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় চাপা কান্নার শব্দ, অশ্রুসিক্ত চোখে প্রিয়জনের প্রতীক্ষায় তারা। যাদের জন্য এ প্রতীক্ষা, তারা সবাই রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিখোঁজ। আরও আছে অনেকে, যাদের নাম এখনও ওঠেনি তালিকায়। গতকাল দিনবাপী এ দৃশ্য দেখা গেছে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। ঢাকা জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তৈরি করা এ তালিকায় সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১০৩০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৮৫৯ নম্বর তালিকায় আছেন আবদুল লতিফ। দিনাজপুরের পার্বতীপুর থানার বেলে ঘাট গ্রামের বাসিন্দা। পিতা সায়রুদ্দিন ছেলের ছবি বুকে চেপে খুঁজে ফিরছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, অভাব তার ছেলেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাই বলে মৃত্যুকূপে পড়ে যাবে এ তার কল্পনায় ছিল না। বুঝতে পারলে ঢাকায় পাঠাতেন না। একই ভাবে ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন মর্জিনা বেগম। তার উপার্জনক্ষম কন্যা রেখা খাতুনের সন্ধানে। নিখোঁজ আলমগীর হোসেন লিমনের খোঁজে পাবনা থেকে এসেছেন বোন ফাতিমা। নিখোঁজ তালিকায় নাম তুলে ধসে পড়া ভবন ও হাসপাতালে ঘোরেন। কিন্তু সন্ধান মেলেনি। একই ভাবে নিখোঁজ তালিকায় নাম রয়েছে লালমনিরহাট জেলার রুজিনা সাম্মী (২৭), মাদারীপুরের নীলা, বগুড়ার আসাদুল ইসলাম, বরিশালের নলছিটি থানার মাজেদা, গাইবান্ধা জেলার মোমেনা, রাশেদা, মানিকগঞ্জের জাহেদা ও রোকেয়া বেগম, টাঙ্গাইলের সুরিয়া বেগম ও কামাল হোসেন। সাভার মডেল থানার এসআই সাইফুল ইসলাম বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য প্রশাসনের নির্দেশে এ তালিকা করা হচ্ছে। তালিকার পাশাপাশি প্রত্যেকের ছবি নিয়ে তাতে তালিকা নম্বর বসিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
এদিকে উদ্ধারের চতুর্থ দিনে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩৫০ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে ৩৬টি লাশ। বাকি লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত রাতেও জীবিতদের উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। আজ থেকে ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু হতে পারে। গতকালও ২৯ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাভার সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২৭৪৫ জনকে।
এদিকে সময় যত গড়াচ্ছে, বাতাসে লাশের গন্ধ ততই তীব্র হচ্ছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে আটকেপড়াদের বাঁচার শেষ সম্ভাবনা। শোকে কাতর সাভারবাসী। থামছে না তাদের মাতম। প্রিয়জনদের খোঁজে এখানে-সেখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই উদ্ধার-তৎপরতায় ক্ষুব্ধ, হতাশ। প্রতিবাদে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে। এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হচ্ছে নিখোঁজ তালিকা।
পোকা-মাকড় খাচ্ছে লাশ: ধসে পড়া ভবনের পূর্ব পাশের সিঁড়ির নিচে এখনও দেখা যাচ্ছে মানুষের মৃতদেহ। বহুতল ভবনের সিঁড়ি দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে তাদের ওপর। এদের একজন কালো রঙের প্যান্ট পরা। উপুড় হয়ে আছে। তার ওপর পুরো সিঁড়ি ধসে পড়ে বাকি শরীর আড়াল করে রেখেছে। এতে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই- তিনি পুরুষ না নারী। উদ্ধারকর্মীরা জানান, যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছে সে অংশ কেটে বের করতে হবে। বাকিটুকু সম্ভব নয়। অন্যদিকে আরেক ব্যক্তির শুধু মাথা টুকু বের হয়ে আছে। কালচে হয়ে গেছে। ফুলে-ফেঁপে উঠেছে চোয়াল, কপাল। বাতাসে ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধ। ওই মৃতদেহগুলোর ওপর ভন ভন করছে অসংখ্য মাছি। ছেয়ে গেছে পোকা-মাকড়। দেশের ইতিহাসে সাভারে ভয়াবহতম ভবন ধসের চারদিন পার হলেও ধ্বংসস্তূপের ভেতর প্রাণের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধার করছেন জীবিতদের। ভবনের উপর ও বিভিন্ন পাশ থেকে সুড়ঙ্গ করে হাত-পা কেটে উদ্ধার করা জচ্ছে চাপা পড়া মানুষদের। গলিত লাশের উৎকট গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ধসে পড়ার ৮২ ঘণ্টা পরও ধ্বংসস্তূপের ভেতরে অসংখ্য প্রাণের আর্তনাদ শুনেছেন উদ্ধারকর্মীরা। তারা নানা কৌশল প্রয়োগ করে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এয়ার ফ্রেশার স্প্রে করে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন তারা। তবে বেক্সিমকো ও ওরিয়ন গ্রুপের উচ্চ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেন আনা হলেও এখনও ব্যবহার শুরু করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেক্সিমকো গ্রুপের নির্বাহী (মেইনটেইন্যান্স) মো. রাশেদ খান বলেন, ১৬০ ও ৭৫ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি ক্রেন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ১১৫ ফুট উচ্চতায় কাজ করতে সক্ষম। তবে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ছাড়া ধসে পড়া ছাদ অপসারণের কাজ শুরু করা যায়নি। এ ব্যাপারে একজন কাপ্টেন পদ মর্যাদার সেনা কর্মকর্তা বলেন, এখনও ভেতরে অনেক জীবিত মানুষ রয়েছেন। তাই ছাদ অপসারণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের নির্দেশ দেয়া হয়নি। জীবিত উদ্ধার সমাপ্ত ঘোষণার পরই ভারি যন্ত্র ব্যবহার করা হবে।
একাধিক উদ্ধারকর্মী জানিয়েছেন, বিরতিহীনভাবে স্থানীয়দের সহায়তায় সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, আনসার, দমকল, রেডক্রিসেন্ট ও বিজিবি সদস্যরা উদ্ধার কাজ করছেন। উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক লাশ। অনেককে আবার জীবিত উদ্ধার করলেও দেখা গেছে হাত-পা কেটে বের করা হচ্ছে। উদ্ধার হওয়া আহতদের সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাভার সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। দুপুর সোয়া ২টার দিকে আসা ওরিয়ন গ্রুপের একটি বিশাল হাইড্রোলিক ক্রেন উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য আনা হয়। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, রেডক্রস সদস্যরা উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্থানীয়রাও কাজ করছেন সেখানে। এদিকে ধসে পড়া ভবনের দেয়াল ও ছাদের কংক্রিটের সঙ্গে এখনও মিশে আছে চাপা পড়া মানুষের মৃতদেহ। কংক্রিটের খাঁজে খাঁজে পিষে থাকা লাশগুলো পচতে শুরু করেছে। এদিকে দুপুরে বৃষ্টি হলেও চলে ধসে পড়া ভবনে উদ্ধার কাজ। এতে সহায়তার জন্য ত্রিপলসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র আগেই হাতের কাছে ছিল বলে উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন। তবে বৃষ্টির কারণে লাশ রাখার স্থান সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে বৃষ্টিতে ভোগান্তি পোহাতে হয় নিখোঁজদের স্বজনদের। সেখানে ত্রিপলসহ সামিয়ানার অভাব ছিল। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া এক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উদ্ধারকারীরা বিভিন্ন তলায় বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ: রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযানের মধ্যে ভবন ধসের জন্য দায়ীদের বিচার দাবিতে বিক্ষোভরত পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। রানা প্লাজার প্রায় এক কিলোমিটার দূরে উলাইল এবং দুই কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ীয়া এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে শনিবার সকালে এই সংঘর্ষ হয় বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সংঘর্ষের কারণে ওই সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। পুলিশ জানায়, ফুলবাড়ীয়া এলাকায় শ্রমিকদের ছোড়া ঢিলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান আহত হয়েছেন। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
সাভার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মশিউদৌলাহ রেজা জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফুলবাড়ীয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে রাস্তায় অবস্থান নেয় কয়েক শ’ পোশাক শ্রমিক। তখন তারা বেশ কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং কয়েক রাউন্ড ফাঁকা রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সোয়া ৯টার দিকে উলাইল বাসস্ট্যান্ডের কাছে পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা ধসে পড়া ভবনের মালিক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্ল্লোগান দিতে থাকে। এ সময় পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা ইট ছুড়তে থাকে। পুলিশ পাল্টা রাবার বুলেট ও জলকামান ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। দু’টি ঘটনায় বেশ কয়েকজন পোশাক শ্রমিক আহত হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
Leave a Reply