লুৎফর রহমান: সাভার ট্র্যাজেডিতে স্তব্ধ গোটা জাতি। লাশের সারি দেখে, স্বজনহারাদের আর্তনাদ শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না মানুষ। বুধবার সকালে ঘটা ভয়াবহ ভবন ধসের পর চার দিন অতিবাহিত হয়েছে। গতকালও ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করা হয়েছে জীবন্ত মানুষকে। বের হচ্ছে আরও লাশ। এখনও নিখোঁজ হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদের সন্ধানে স্বজনরা ভিড় করছেন ধসে পড়া ভবনের চারপাশে। জীবিত না হলেও অন্তত প্রিয়জনের লাশটি চাইছেন তারা। অভিযোগ তুলছেন উদ্ধারকাজে ধীরগতির। এ অভিযোগ আসছে গত চার দিন ধরেই। এ পর্যন্ত কয়েক দফায় অপেক্ষমাণ স্বজন ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন উদ্ধারকারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে। মানবিকতার তাগিদে অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যাচ্ছেন সাভারে। কেউ খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধার সামগ্রী। কেউ বা যাচ্ছেন উদ্ধার কাজে অংশ নিতে। এমন শ’ শ’ মানুষ সেখানে টানা চার দিন ধরে অংশ নিচ্ছেন উদ্ধারকাজে। নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রবেশ করছেন মৃত্যুকূপে। তুলে আনছেন জীবিত মানুষ। আনছেন হতভাগা শ্রমিকদের নিথর দেহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার দিনই ভবনে নানাচাড়া তত্ত্ব প্রকাশ করে শোকাহত মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বেলে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সাভার ট্র্যাজেডির মূল হোতা সোহেল রানাকে তার দলের কর্মী নয়- এমনটি প্রমাণের হাস্যকর চেষ্টা চালিয়েছেন। জানিয়েছেন, সাভার যুবলীগের কমিটিতে রানার নাম নেই। স্থানীয় এমপি তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ রানার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। গতকাল যখন স্থানীয় এমপি’র সঙ্গে রানার অন্তরঙ্গ ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী আর কোন ব্যাখ্যা দিতে যাবেন না। মুরাদ জং-ও নিশ্চয়ই লা-জবাব। এমন ট্র্যাজেডির মধ্যে মন্ত্রী- এমপিদের এমন বক্তব্যে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। কোথাও কোথাও ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নিচ্ছে। তবে ক্ষোভ আর বিক্ষোভের মধ্যেও আশার কেন্দ্রে এই মানুষই। সাভার ট্র্যাজেডিতে যে যোদ্ধারা মৃত্যুকূপে জীবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছেন তারা সাধারণ মানুষ। তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, উদ্যম, সাহসের কোন তুলনা হয় না। নিজে বাঁচবে কি বাঁচবে না- তা না ভেবে তারা চলে যাচ্ছেন মৃত্যু সুড়ঙ্গ বেয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে। অবিরাম চলছে তাদের সে চেষ্টা। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তারা পড়ছেন পদে পদে বাধার মুখে। নেই দেয়াল ভাঙার মতো হাতুড়ি। নেই রড কাটার করাত। শাবল নেই, টর্চলাইট নেই। নেই সামান্য দড়ি-কাছিও। অক্সিজেন, এয়ারফ্রেশনারসহ অন্য উদ্ধার সামগ্রীও পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত। ভবনের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ডে তারা এসব সামগ্রী চেয়ে আবেদন জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষের প্রতি। মানুষ অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন দেয়ার মতো সবটুকু সামর্থ্য। হাতুড়ি, শাবল নিয়ে, করাত নিয়ে, কাপড় নিয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার, খাবার পানি নিয়ে সাধারণ মানুষ ছুটছে সাভারের দিকে। হাসপাতাল থেকে আহত রোগীদের রক্ত ও ওষুধের প্রয়োজন জানিয়ে আহ্বান আসছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমেও এসব আবেদন জানানো হচ্ছে। জানিয়ে দেয়া হচ্ছে কোথায় কোন উপকরণটি কিনতে পাওয়া যায়। হাজারো মানুষ মত-পথ ভুলে দাঁড়াচ্ছেন রক্ত দেয়ার লাইনে। নিয়ে যাচ্ছেন ওষুধও। এত বড় বিপর্যয়ে ত্রাতা হয়ে সামনে এসেছে সাভারের বেসরকারি হাসপাতাল এনাম মেডিকেল। শ’ শ’ রোগীর চিকিৎসা, ওষুধ, খাদ্য সবই বিনামূল্যে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাত-দিন খেটে যাচ্ছেন। চিকিৎসকরা রোগীর ট্রলি টেনে নিয়ে আসছেন বেডে। এটি এক বিরল দৃশ্য। শুরুতে সাহস নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন তিনি একা নন। পুরো দেশ তার পাশে। তার হাসপাতালটি এখন সেবার এক অনন্য নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু উল্টো দৃশ্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে। সেখানেও ভর্তি হয়েছে অসংখ্য আহত মানুষ। তবে সেখানে আছে রোগীর অভিভাবকদের নানা অভিযোগ-অনুযোগ। অনেক রোগীর অভিভাবকও নেই। খবরে জানা গেছে, বেসরকারি কলেজের শিক্ষক, গৃহিণীরা মানবতার ডাকে সাড়া নিয়ে স্বজন হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন আহতদের।
গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৩৫০ লাশ বের হয়েছে ধসে পড়া ভবনের নিচ থেকে। শ’ শ’ লাশ নিয়ে যাওয়ার মতো হাতের কাছে কফিন পাচ্ছেন না স্বজনরা। সংবাদ এসেছে সাভারের একটি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এ পর্যন্ত ৩০টি কফিন দিয়েছেন লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে আরও কফিন তারা প্রস্তুত রেখেছেন। এত আবেদন এবং অভাবের মধ্যেও আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রটি যেন অন্ধ হয়ে আছে। নির্লিপ্ত, নির্বিকার সরকারও। এত বড় একটি মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনায় সরকারের কোন উদ্বেগ নেই। অনুভূতিও নেই। মানুষের চোখে জল। কিন্তু রাষ্ট্রের সব কিছু আগের মতোই চলছে। বাড়তি কোন তাড়াহুড়ো নেই। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষের জন্য যেন কোন দরদ নেই। মমতা নেই। মনে হয় রাষ্ট্রটি যেন বিত্তহীনের জন্য নয়। বিত্তহীনরাই এই রাষ্ট্রের জন্য। তারা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখবে এটিই যেন চিরন্তন নিয়ম।
অথচ এই সাধারণ মানুষরাই একদিন যুদ্ধ করে, জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করেছিল। এই মানুষরাই এখনও রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। মানুষের জীবন বাঁচানো ও অধিকার রক্ষা যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেখানে রাষ্ট্রের পরিবর্তে এই মানুষরাই আগে এগিয়ে আসছে মানুষের জীবন বাঁচাতে। মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্রটি যখন ভিক্ষুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, ব্যর্থতার পরিচয় দেয় তখন এই মানুষই রাষ্ট্রের রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটি আমরা দেখছি সাভারে। রাষ্ট্রের সকল দৈন্য ম্লান করে সাহসী মানুষ ধ্বংসস্তূপে জীবনের জয়গান গেয়েছে।
উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে ক্ষোভের অনেক কারণ আছে। সেখানে শুরুর দিন থেকে সেনাবাহিনীর সাধারণ চারটি ইউনিট কাজ করছে। তারা শৃঙ্খলা রক্ষা এবং উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছেন। উদ্ধারকাজে আছে ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, পুলিশসহ অন্য অনেক সরকারি সংস্থার লোকজন। আছেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্ধারকর্মীরাও। অন্য উদ্ধারকারীরা অভিযোগ করেছেন, সেনা সদস্যরা ভেতরে যাচ্ছেন না। হয়তো এটি শুধু অভিযোগই হতে পারে। কিন্তু অনেকে বলছেন, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল কোরের সদস্যদের সেখানে পাঠানো হলো না কেন? তারা তো সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ ও মেধা কাজে লাগাতে পারতেন। প্রশ্ন উঠছে একটি মাত্র ভবনে আটকে থাকা লোকজনকে জীবিত উদ্ধার করতে এ হিমশিম অবস্থা হলে বড় কোন বিপর্যয় হলে তখন পরিস্থিতি কেমন হবে?
এখন পর্যন্ত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কেউ সাভারে যাননি। মন্ত্রীরা যাচ্ছেন কেউ কেউ। সরকারি দলের তৎপরতাও সেখানে তেমন দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের ভূমিকাও দায়সারা। আলোচিত হেফাজতে ইসলাম আর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বাহবা কুড়াচ্ছেন উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নিয়ে।
শপথ নেয়ার পর প্রেসিডেন্ট সাভার গিয়েছিলেন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারেও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সাভার যাওয়ার পথে ধসে পড়া ওই ভবনটির পাশে তিনি এক মুহূর্তের জন্য হলেও দাঁড়াতে পারতেন। তিনি তা করেননি। প্রধানমন্ত্রীও যাননি। তার প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেখানে না যাওয়ার পেছনে যুক্তি হলো ভিআইপি মর্যাদার কেউ সেখানে গেলে উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন হবে। এই যুক্তি কেউ মানছেন, আবার কেউ মানছেন না। বিরোধী নেত্রী গিয়েছিলেন সাভারে। তার সে যাওয়াকেও নেতিবাচক হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে সরকারের তরফে।
রানা প্লাজায় উদ্ধার তৎপরতা চলছে। দুর্ঘটনার আজ পঞ্চম দিন। ধ্বংসস্তূপ থেকে আর কেউ যদি জীবিত বের হয়ে আসেন তা হবে দৈব ঘটনা। নিখোঁজদের জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনরা। গতকাল পর্যন্ত উদ্ধারে ভারি যন্ত্র ব্যবহার হয়নি। আজ হয়তো হবে। গতকাল থেকেই ভারি উদ্ধার সামগ্রী জড়ো করা হয়েছে। এ আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে জানিয়েছেন এত আয়োজন আগের চার দিন চোখে পড়েনি।
Leave a Reply