স্বদেশ জুড়ে ডেস্ক: সাভার ট্রাজেডির আরেক হোতা ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক গ্রেপ্তার। পুলিশ সোমবার দুপুরে ঢাকার মগবাজার এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভবন ধসে হতাহতের ঘটনায় রানা ও গার্মেন্ট মালিকদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় যে দুটি মামলা হয়েছে তার এজাহারে আবদুল খালেকের নামও রয়েছে। হতাহত ব্যাক্তিসহ দেশের আপামর জনসাধারণের তোপের মুথে সরকার রানা ও তার বাবাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাভারে ভবন ধসে হতাহতের ঘটনায় মূলত রানাই দায়ী। আগের দিন ফাটল ধরার পরও তিনি ভবন খুলে দেন এবং ওই ভবনে থাকা পাঁচ কারখানার শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেন। অবশ্য রানার দাবি, কারখানা মালিকদের চাপেই তিনি ফাটল ধরা ভবনে কাজ চালাতে দিয়েছিলেন। গামেন্টস মালিকরা বলছেন, বিদেশী বায়রদের চাপে সময়মত মাল ডেলিভারী দিতে তারা শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করেন।
বিদেশী বায়ারদের সবাই বলছে, এটা খুবই মর্মান্তিক। আমরা কখনো এটাকে সর্মথন করি না। কাজের পরিবেশ এতই অনুন্নত ছিল সে সম্পর্কেও আমরা অবগত ছিলাম না। আমাদের ভুল বোঝানো হয়েছিল। এই নিন্দনীয় কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গামের্ন্টস মালিকদের নিতে হবে। এভাবেই একজনের দোষ আরেক জনের কাধে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
কিন্তু দেশবাসীর একটাই দাবী দোষী সকল ব্যাক্তিদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করুন।
রোববার রাত সাড়ে ১১টায় দুটি হাইড্রোলিক ক্রেন দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু হয়। প্রথমেই একটি ক্রেন দিয়ে সরানো হয় প্রায় অর্ধেক দাঁড়িয়ে থাকা একটি পিলার।
জীবিতদের উদ্ধারের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় এর আগে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়নি; যদিও তা কয়েকদিন আগেই আনা হয়েছিল।
ভয়াবহ এই ভবন ধসে এই পর্যন্ত ৩৭৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আড়াই হাজার জনকে।
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে চার দিন পরও জীবিতদের সন্ধান মেলায় ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে কেটে কেটে গর্ত তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে সন্ধান চালাচ্ছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। রোববার দুপুরেও জীবিত উদ্ধার হন পাঁচজন।
উদ্ধারকর্মীদের ধারণা অনুযায়ী সর্বশেষ জীবিত একজনকে উদ্ধারে রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত চেষ্টা চলে। কিন্তু শাহীনা নামে ওই পোশাককর্মীকে উদ্ধারে ভবনের কনক্রিটের রড কাটার সময় আগুন ধরে যায়। এতে আহত হন তিনজন উদ্ধারকর্মী।
সেখানে উদ্ধার অভিযানে থাকা এক দমকলকর্মী বেরিয়ে আসার সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, তারা ওই নারীকে উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছেন।
এরপরই বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। রাতে এক পর্যায়ে ধসে পড়া ভবনের চৌহদ্দী থেকে সাংবাদিকসহ সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়। সেখানে ছিলেন শুধু উদ্ধারকাজে যুক্ত সেনাবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা।
ভারী সরঞ্জাম ব্যবহার শুরুর আগ মুহূর্তে সাংবাদিকদের ডেকে নেয়া হয় ৩৫ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে নির্মিত এই ভবনের পেছন দিকে, যে ভবনটি যুবলীগ নেতা সোহেল রানা বেআইনিভাবে নির্মাণের অভিযোগে ইতোমধ্যে মামলা হয়েছে।
সেনা কর্মকর্তারা জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্ধার কাজ শুরু করছেন তারা।
এই অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমল কবীর সাংবাদিকদের বলেন, “কেউ জীবিত নেই বলে ধারণা করেই আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্ধার কাজ শুরু করেছি।”
তবে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সময় নিয়ে এগোচ্ছি। ধীরে ধীরে কাজ করা হবে।”
কেউ বেঁচে থাকলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত যেন না হন সেজন্য এই সতর্কতা বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমল।
ভারী সরঞ্জাম ব্যবহারের আগে ধ্বংসস্তূপে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে রাত ১০টা ৫ মিনিটের দিকে। শাহীনাকে উদ্ধারে রড কাটার সময় স্ফূলিঙ্গ থেকে গার্মেন্টসের কাপড়ে আগুন লেগে যায়।
ধসে পড়া এই ভবনে পাঁচটি কারখানা ছিল। মঙ্গলবার ফাটল দেখা দিলেও বুধবার মালিক পক্ষ কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে বলে শ্রমিকদের অভিযোগ।
আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে এবং ২০ মিনিটের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণেও আনে।
সেখানে থাকা বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক জাফর ইমাম সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই উদ্ধার তৎপরতার সময় শাহিনা আক্তারের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন তিনি। শাহীনাকে ভেতর থেকে আনতে রড কেটে গর্ত তৈরি করা হচ্ছিল, তখনি আগুন ধরে যায়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক শাহিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দুপুর ২টার দিকে তারা শাহিনার অবস্থান জানতে পেরেছিলেন, তবে তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারছিলেন না।
গত বুধবার সকালে ভবন ধসের পর প্রথমে স্থানীয়রা উদ্ধার কাজ শুরু করেন, এরপর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উদ্ধার অভিযান চললেও স্চ্ছোসেবকরা ঝুঁকি নিয়েই কাজ অব্যাহত রাখেন, যাদের প্রশংসা প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীদের মুখেও শোনা গেছে।
শুরু থেকে ছোট ছোট গর্ত করে বিভিন্ন স্থান থেকে জীবিতদের উদ্ধার করা হচ্ছিল, এর মধ্যে লাশ উদ্ধারও চলছিল।
আহতদের অধিকাংশকেই নেয়া হয়েছে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও নেয়া হয় অনেককে।
লাশ রাখা হচ্ছে সাভার অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সেখানে সনাক্ত করে লাশ গ্রহণ করেন স্বজনরা। সেসব লাশের কোনো দাবিদার তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি, তা পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে।
জীবিতদের উদ্ধারে গুরুত্ব দিয়ে চারদিন ধরে অভিযান চালানোর পর রোববার সকালে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়।
উদ্ধার অভিযানে থাকা বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সঞ্জিব সাহা জানান, বুলডোজার, ক্রেন, ফর্কলিফ্টার, ডাম্পার, এক্সকেভেটরসহ বিভিন্ন ভারী যন্ত্র আনা হয়েছে।
কিন্তু সকালে জীবিত আরো কয়েকজনের সন্ধান পাওয়ার পর এসব ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার আপাতত না করার সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর সন্ধ্যায় ধ্বংসস্তূপের চারপাশে প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীরা ছাড়া আর সবার ঢোকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে সচল হয় ভারী যন্ত্রগুলোর ইঞ্জিন।
ক্রেন ও ফর্কলিফটার দিয়ে ভবনের বিভিন্ন ভারী কংক্রিটের টুকরা উঠানো হবে।এক্সকেভেটর আর বুলডোজার ধসে পড়া ভবনের বিভিন্ন অংশ সরাবে। ইট-কংক্রিটের টুকরো সরিয়ে নেয়ার জন্য বেশ কয়েকটি ডাম্পার আর ট্রাক আশেপাশেই রাখা হয়েছে।
Leave a Reply