কাজী সোহাগ: সাভার ট্রাজেডির ঘটনায় দোষী হিসেবে চিহ্নিত সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে হরতাল দিয়েছিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সোহেল রানার পরিচয় সে যুবলীগ নেতা। ঘটনার পরপরই স্থানীয় এমপি মুরাদ জং তাকে উদ্ধার করে জনসম্মুখ থেকে সরিয়ে দেন। অনেকের মতে তাকে পালাতে উৎসাহিত করেন এমপি। যারা চোখ কান খোলা রেখে সাভারের ঘটনা সরজমিনে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা দেখেছেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন-স্থানীয় এমপি কি আর কাউকে উদ্ধার করেছেন। জীবিত কিংবা মৃত। গত কয়েক দিনে পত্র-পত্রিকায় অনেক উদ্ধারকর্মীর তৎপরতা দেখেছি। দেখেছি তাদের সাহসিকতা। জীবিত উদ্ধারে তাদের চোখে মুখে যেমন ছিলো হাসির ঝিলিক তেমনি কারও লাশ উদ্ধারের পর তাদের চেহারার ভাষা ছিলো কালো মেঘের মতো অন্ধকারাছন্ন। এদের বেশিরভাগই নাম না জানা। কেউ ছাত্র, কেউ চাকরিজীবি আবার কেউ শ্রমজীবি। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তারা। প্রশ্ন উঠতে পারে-এসব উদ্ধারকারীরা কেন জীবনবাজি রেখে উদ্ধার তৎপরতায় নামলেন। উত্তর হতে পারে- বাঙ্গালী মানবিকতা, মানসিকতা। এগুলোই আসলে তাদের ঝুঁকি নেয়ার অন্যতম মসলা। উজ্জীবনী শক্তি। কোন ধরনের স্বার্থের হাতছানি এতে ছিলো না। ছিলো না কোন ধরনের আর্থিক চাওয়া-পাওয়া। ক্রিকেটিয় পদ্ধতিতে এদের অনেকের স্কোর দাঁড়াবে অনেকটা গর্বের মতো। যেমন-উদ্ধারকর্মী আমিনুল হক। তার নামের পাশে স্কোর আকারে দেখালে লিখতে হবে-মোট উদ্ধার ৮০ জন। জীবিত-৬০ জন। মৃত-২০ জন। কঠোর পরিশ্রম আর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি এ স্কোর দাঁড় করিয়েছেন। আমরা স্যালুট জানাই তার এ সফলতায়। সাহসিকতা আর পরম মানবিকতায়। তিনি পরিচিত কোন ব্যক্তি নন। এ ঘটনার আগে তাকে কেউ চিনতেনও না। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়ার সুবাদে এখন তিনি পরিচিত এক মুখ। এবার আসি পরিচিত মুখের পারফর্মেন্স বিশ্লেষনে। তিনি সাভারের এমপি মুরাদ জং। জীবনবাজি রাখা ওইসকল উদ্ধারকর্মীদের মতো তিনিও উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলেন। তাই তার নামের পাশে স্কোর দাঁড়িয়েছে-মোট উদ্ধার-১জন (সোহেল রানা), জীবিত-১ জন (সোহেল রানা), মৃত-নেই। ব্যপক জনপ্রিয় দাবিদার এই এমপির স্কোর বলে দিচ্ছে তিনি ওইদিন কতোটা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে তিনি উদ্ধার করেছিলেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে। শুধু উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন নিরাপদ স্থানে। কারণ ভবন ধসের পর যেভাবে ইট-বালু আর সুরকি ছড়িয়েছে তাতে সোহেল রানার মতো নেতাকে ওই স্থানে রাখা সম্ভব নয়। আমিনুল হকের উদ্ধার অভিযানে ছিলো না কোন স্বার্থ। এটা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে মুরাদ জংয়ের উদ্ধার অভিযানের পেছনে ছিলো টাকার মেশিন রক্ষার প্রানান্তকর চেষ্টা। রিমান্ডে সোহেল রানা স্বীকার করেছে, সে ছিলো এমপির টাকা বানানোর মেশিন। তাকে ব্যবহার করে এমপি মহোদয় গড়ে তুলেছেন কালো টাকার পাহাড়। আর তার ছিটেফোটা পেয়ে সেও বনেছে কোটিপতি। এবার মুল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শুরু করেছিলাম খালেদা জিয়ার হরতাল আহ্বান নিয়ে। কেন তিনি হরতাল দিয়েছিলেন তা সবারই জানা। রানা প্লাজার মালিক রানাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে তিনি এ হরতাল আহ্বান করেছিলেন। ঘটনার পরই লাপাত্তা হয়েছিলেন সোহেল রানা। গুজব ছড়িয়ে পড়ে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার প্রাণপন চেষ্টা করছে যুবলীগ নেতাকে রক্ষার। ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে হরতালের মতো কর্মসুচি দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তাদের সঙ্গে সুর মেলায় আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাই অনেকটা চাপের মুখে বাধ্য হয়ে সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরই বিরোধী জোটের কাছে হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দুই নেত্রীর রাজনৈতিক রেওয়াজ বিশ্লেষণ করে অনেক বোদ্ধাই ধারণা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন খালেদা জিয়া। কারণ ইতিবাচক কোন বিষয়ে দুই নেত্রীর মধ্যে মিল হয়েছে এমন নজীর নেই। এ যুক্তির ওপর ভর করে স্বাভাবিকভাবেই আরও একটি হরতাল পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মনে মনে। ওইদিন কি কি করা হবে সে রুটিনও অনেকটা ঠিক করে ফেলেছিলাম। আর ভাবছিলাম দেশের অর্থনীতি নিয়ে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমাদের বাণিজ্যিক অবস্থা- এ চিন্তায় যখন মশগুল তখনই অনেকটা অবিশ্বাস্যের মতো শুনলাম হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণা। টেলিভিশনগুলোতে এ নিয়ে ব্রেকিং দিচ্ছে। সংবাদটি নিজ কানে ও চোখে দেখেও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিছু সময় পরে অবশ্য নিজের বিশ্বাস নিয়েই সন্দেহ পোষন করি। বিরোধী জোটের ঘোষণাকে যখন সত্যি মনে হলো তখন মনের অজান্তেই দুই হাত এক করে হাততালি দিয়ে উঠি। বাহবা দিই আমাদের বিরোধী দলীয় নেত্রীকে। মনে মনে সুখ অনুভব করি। ভাবি-দেশের সব বিষয়ে যদি এরকম রাজনীতি চর্চা হয় তাহলে কতই না ভালো হতো। মনের অজান্তে হাততালি আরও একবার দিয়েছি। যখন সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হরতাল প্রত্যাহারের জন্য বিরোধী দলীয় নেত্রীকে ধন্যবাদ জানান। কেন জানি তখন মনে হয়েছিলো- আমরা কি পরিবর্তন হচ্ছি? বদলাচ্ছে আমাদের চিন্তা-ভাবনা? রাজনৈতিক চর্চা? তৈরি হচ্ছে পরমতসহিষুতা? এ ঘটনার পর দুই নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জন্মালো বেশ খানিকটা। আমজনতা হিসেবে আমরা আসলে তাদের শ্রদ্ধাই জানাতে চাই। অপরকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে একধরনের তৃপ্তি আছে। আমি চাই আমাদের রাজনীতি নিয়ে প্রতি মুহুর্তে এ ধরনের তৃপ্তি পেতে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের শেষ দিকে যখন দুই নেত্রী সেনাকুঞ্জে পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তখন উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন। তাদের মুখের চওড়া হাসিই বলে দেয় এ দৃশ্য তাদের কাছে কতটা আকাংখিত। বিশেষ করে তৎকালীন উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের সুপ্রশস্ত হাসি দেখে মনে হয়েছে আরে এটাইতো আমার হাসি। আমার আনন্দ। দুই নেত্রীকে বলতে চাই, আমরা আপানাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে হাততালি দিতে চাই। অবিরাম। অবিরত। আমরা না খেয়ে থাকতে রাজি আছি। তবু আপনাদের সহনশীল রাজনীতি দেখতে চাই। আমরা বাঙ্গালী। আমরা সাহসী। ইতিবাচক রাজনীতি এই আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা সবাই জানেন। আপনারা আরও ভালো জানেন। সাভারের ঘটনায় উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলো বিদেশিরা। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দেশের নীতিনির্ধারকরা তা প্রত্যাখান করেছেন। এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমরা বাঙ্গালীরা নিজেদের বঁচাতে নিজেরাই যথেষ্ট। আমার এক সহকর্মীকে রসিকতা করে বলছিলাম-আসলে বিদেশিদের আসার অনুমতি দেয়ার প্রয়োজন ছিলো। তাহলে তারা দেখার সুযোগ পেতো-কিভাবে বীর বাঙ্গালী তাদের ভাই-বোন-সস্তানদের রক্ষা করছে। প্রশিক্ষিত না হয়েও কিভাবে মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে, মানবতাকে উদ্ধার করা যায়। আমার ধারণা-বিদেশিরা সচক্ষে দেখে তারা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। দেখতো বাঙ্গালীর সাহসিকতা। মানবতা। আর স্যালুট জানাতো সমগ্র বাংলাদেশীদের। নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে তারা বলতো- যা দেখে এলাম তা সত্যিই বিরল। স্যালুট জানাই বাংলাদেশীদের, বাঙ্গালীদের।
সৌজন্য: মানবজমিন।
Leave a Reply