ঢাকায় ছিলাম না। নিজ চোখে দেখিনি সাভারের রানা প্লাজায় কি ঘটেছিল। পত্রিকায় দেখেছি। টিভি’র পর্দায় দেখে মনে হয়েছে এই মৃত্যুর কাফেলা কবে থামবে। তাজরিন গার্মেন্টের আগুন দেখতেও সেখানে গিয়েছিলাম। মাত্র ১৫১ দিনের মাথায় এত মৃত্যু, এত লাশ। এত কান্না। আহাজারি। শুক্রবার বিকাল পৌনে চারটায় রওয়ানা হলাম। সঙ্গে সহকর্মী লায়েকুজ্জামান। অপর দুই সহকর্মী নূরুজ্জামান ও হাফিজুর রহমান দশদিন ধরে সাভারেই রাত কাটায়। মুহূর্তেই খবর দেয়। যা আমরা অগণিত পাঠককে জানাই অনলাইনে, প্রিন্ট সংস্করণে। মাঝপথে আটকে গেলাম। প্রচণ্ড যানজট। প্রেসিডেন্ট গেছেন সাভারে। তাই রাস্তা বন্ধ। প্রায় দুই ঘণ্টায় গাড়ি এবং কিছুটা পায়ে হেঁটে যখন রানা প্লাজার সামনে পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবে ডুবে। লাশের গন্ধে বাতাস ভারি। এর মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায়। কেউ এসেছেন স্বজনদের খোঁজ নিতে। কেউ এসেছেন ধ্বংসস্তূপ দেখতে। আবার অনেকে এসেছেন রানার সাম্রাজ্য দেখতে এবং ঘৃণা জানাতে। নিরাপত্তা কর্মীদের হয়েছে বিপদ। তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। রানা প্লাজার ঠিক বিপরীতেই সেনা কন্ট্রোল রুম। যেখান থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যে অভিযানের কোন নাম নেই। সম্ভবত সেনাবাহিনী দিনের পর দিন এমন একটি অভিযান পরিচালনা করছে যার কোন নাম নেই। একজন জুনিয়র অফিসার বললেন, বলতে পারেন মানবিক অভিযান। সত্যিই এটা এক মানবিক অভিযান। যে অভিযানের নেতৃত্বে রয়েছেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী। এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত এই সেনা অফিসারের সঙ্গে কথা বললাম প্রায় ৪০ মিনিট। যেভাবে বর্ণনা দিলেন অপারেশনের তাতে মনে হলো আমরা অনেক কিছুই জানি না। গত ১০ দিনে কি হয়েছে এই রানা প্লাজায়। বড্ড আবেগপ্রবণ এই জেনারেল। বললেন, আল্লাহ কেন আমাকে এমন জিনিস দেখালো। মানুষের বাঁচার কি আকুতি। শাহীনার কথা বলতে গিয়ে এমনটাই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। তখন তার চোখে পানি। আমার একটা দেড় মাসের বাচ্চা আছে। আমি ফিরে যেতে চাই। তাকে দেখতে চাই। তাকে তখন বলা হলো, আপনি খাবার নেন, পানি নেন, অক্সিজেন নেন। তার জবাব, ওসব আমার লাগবে না। আমি এখন খাবো না। বের হয়ে দুপুরে আপনাদের সঙ্গে খাবো। কি যে আকুতি। তাকে বের করতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমার অফিসার ক্যাপ্টেন হাসান, ফায়ার ব্রিগেডের একজন কর্মী এবং ইঞ্জিনিয়ার এজাজ মিলে তার হাতে একটা কাটার মেশিন দিলো। বললো, আপনি নিজে চেষ্টা করেন। ছিদ্রটা বড় করা যায় কিনা। খুব কষ্টে তাকে চৌদ্দ ঘণ্টা পর তার ঘাড় পর্যন্ত বের করা হলো। কিন্তু বাকিটা বের করা যাচ্ছিলো না। তার জন্য সব মেকানিক্যাল অপারেশন বন্ধ রাখা হলো। রাত ১০টার দিকে ওরা এসে আমাকে বললো, স্যার এভাবে বোধহয় আর হবে না। বরং আমরা একটা রড কেটে দেই। কাটা শুরু হলো। কিন্তু খেয়াল করা হলো না, তার জন্য দুটো অক্সিজেনের লাইন দেয়া আছে। আর তখনই ওই লাইন থেকে স্পার্ক হয়ে আগুন লেগে যায়। ওই আগুনে প্রকৌশলী এজাজের শরীরের প্রায় ৬০ ভাগ জ্বলে যায়। পরবর্তীতে তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। আর শাহীনার ব্যাপারটা দাঁড়ালো আরও মর্মস্পর্শী। অফিসাররা ফিরে এসে বললো স্যার, সব শেষ। সবাই কান্নাকাটি করছে। অনেক চেষ্টার পরও আগুন আমরা নিভাতে পারলাম না স্যার। রাত ৩টায় কনফার্ম করা হলো শাহীনা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে- না ফেরার দেশে। পরদিন আবার একটা ফোন এলো। আমি শাহীনা বলছি। আমি বেঁচে আছি। আসলে ফোনটি তাকে দেয়া হয়েছিল। আমাদের ক’জনের নাম্বার দেয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু ওই নাম্বারটি ছিল না আমাদের কাছে। ফোনটি বেজে উঠেছিল। উদ্ধার কর্মীরা আবারও চেষ্টা করলেন। শাহীনা কোথায়? নিচে গিয়ে দেখা গেল দুটো হাত। নিথর শাহীনা। জেনারেল তখন কিছুটা নিজেকে সামলিয়ে বললেন ‘আমি জানি না আর কতদিন এভাবে মানুষের হাত-পা কেটে আমাকে মানুষ বের করতে হবে’।
মানুষ পঙ্গু হয় জানি। রণাঙ্গনেও দেখি আমরা। কিন্তু সাভারে যা দেখলাম তা কি ভাষায় বর্ণনা করবো? ১১০০ মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছেন। যাদের মধ্যে কারো হাত নেই। কারো নেই পা। বুকের পাজরও ভেঙে গেছে অনেকের। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে তাদের। ১৯ জনের অবস্থা সত্যিই আশঙ্কাজনক। আরও কত কিছু যে দেখতে হবে আল্লাহ মালুম। তবে হ্যাঁ, আমরা এখানে আছি। শেষ দেহটিও উদ্ধার করে এলাকা ছাড়বো। জেনারেল তখন কিছুটা শান্ত। যদিও কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো বার বার। বলছিলেন, চোখের সামনে এত লাশ দেখিনি। তাজরীন অপারেশনে দেখেছিলাম। তবে এমন মৃত্যু নয়। যে মৃত্যু বিশ্ব বিবেককেও নাড়া দিয়েছে। এই গার্মেন্ট মালিকগুলো বিবেকবান হলে এমনটা হতো না। আগের দিন প্রশাসন সতর্ক করলো। ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হলো। তারপরও কারখানা চালু রাখার ঘোষণা দিলো এই মালিকরা। আর রানা? সে তো তার প্রাসাদে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল। ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে তার ছিল আধুনিক সাজে সজ্জিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। যেখান থেকে একটি মার্কিন তৈরি পিস্তলও পাওয়া গেছে। পিস্তলটি এখন পুলিশের জিম্মায়। সে কিছুটা আহত হয়েছিল। লোকজনের সহযোগিতায় তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। কারা নিলো, বিস্তারিত বিবরণ দিলেন না। তবে বললেন, ভবনটি নির্মাণে কারিগরি কোন দিকই মানা হয়নি। ডিজিটাল যুগে এমন বিল্ডিং তৈরি হতে পারে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। আবারও উদ্ধার প্রসঙ্গ। ভবন ভেঙে পড়ার মুহূর্ত। ৯টা ৭ মিনিটে ভবনটি ভেঙে পড়ে। জেনারেল পৌঁছে যান মাত্র ১১ মিনিট পর। সাভার সেনানিবাসের খুব কাছে বলে দ্রুত পৌঁছা সম্ভব হয়। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করেছেন। জানতে চেয়েছেন তিনি কোথায়? ঘটনাস্থলে রয়েছি শুনেই প্রধানমন্ত্রী ফোন রাখলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়াও ফোন করলেন। আসলে কারো নির্দেশের অপেক্ষায় আমি ছিলাম না। একটা বিষয় না বললেই নয়, এ উদ্ধার কাজে এত জনগণ কি করে আসলো? সম্ভবত ধ্বংসযজ্ঞের খুব কাছেই কোন একটা রাজনৈতিক সভা বা কিছু একটা ছিল সরকারি দলের। সেখানে বেশ কিছু ছাত্র-জনতা ছিল। বাজারের লোকজন ছিল। এদের মধ্যে ৭-৮শ’ বা হাজার লোক যা ছিল হাতের কাছে খালি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কারো কোন অভিজ্ঞতা নেই। যে যেভাবে পারেন সেভাবেই লেগে যান উদ্ধারে। দা, কুড়াল, ছুরি, কাচি নিয়ে আসেন অনেকে। সেনা ইউনিটগুলোও যোগ দেয়। ১১০০ সৈন্য এতে অংশ নেয়। অন্যান্য বাহিনীও এসে পড়ে তখন। ব্যক্তি উদ্যোগেও ঝাঁপিয়ে পড়েন অনেকে। মিডিয়া খবর প্রচার করায় তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার ব্রিগেড নেমে পড়ে কাজে। সময় যত গড়ায় তখন মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। একে একে লাশের মিছিল লম্বা হতে থাকে। সম্পূর্ণ ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উদ্ধার অভিযান চলেছে। আধুনিক প্রযুক্তি অনুপস্থিত। বাংলাদেশে তা নেইও। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, পাট বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে প্রায়। বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। অথচ একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। একজন সরব মন্ত্রীও রয়েছেন। রাজনীতিতে মাঝে মধ্যেই তিনি বিতর্কের যোগান দেন। আমরা কি দেখছি? ২০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা যেখানে, সেখানে নেই কোন আলাদা মন্ত্রণালয়। নেই কোন নিয়ন্ত্রিত সংস্থাও। বাংলাদেশ বলেই কথা। বিভ্রান্তি রয়ে গেছে নিখোঁজ বা নিহতের সংখ্যা নিয়ে। জিজ্ঞেস করেছিলাম জেনারেল সোহরাওয়ার্দীকে। নিশ্চিত নন তিনিও। বললেন, এর মধ্যে যখন শুনি লাশ গুমের কথা, তখন কষ্ট লাগে। যাই হোক, অপারেশনের সমাপ্তি টানা হলেই এসব বিতর্কের অবসান ঘটবে। তবে হ্যাঁ, এর অনেকটা নির্ভর করছে বিজিএমইএ’র উপর। তারা যদি সঠিক তালিকা দেয় তাহলেই বোঝা যাবে আসলে কত শ্রমিক ছিল, সর্বনাশা রানা প্লাজায়।
মতিউর রহমান চৌধুরী সাভার, ঢাকা
সৌজন্য: মানবজমিন
Leave a Reply