অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বদলে গেছে গোটা দৃশ্যপট। সংলাপের আশা চাপা পড়েছে সংঘাত আর সহিংসতার রক্তপাতময় বিভীষিকায়। সাভারের ভবন ধসের ভয়াবহতা কাটেনি এখনও। ওই ভবনের উদ্ধারকাজ চলার সময় সরকারের আহ্বানে দুই দফা হরতাল প্রত্যাহার করে কিছু আশা জাগিয়েছিল বিরোধী দল। সরকারি দলেরও ছিল নমনীয় সুর। আশা সঞ্চার হয়েছিল, স্বস্তি ফিরেছিল জনমনে। কিন্তু সেই স্বস্তিটা দু’এক দিনের বেশি স্থায়ী হলো না। ৫ই মে হেফাজতে ইসলামের অবরোধ, শাপলা চত্বরে অবস্থান এবং তাদের হটাতে সরকারি বাহিনীর রুদ্ধশ্বাস অভিযানের পর পুরো দেশে এখন গুমোট হাওয়া বইছে। রাজনীতিতেও সংঘাতের কালো ছায়া। ৫ই মে হেফাজতের অবরোধে সহিংসতা, হামলা ও পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৩ জন মারা যান। এদিন মধ্যরাতে হেফাজত কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে সরাতে যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় ৭ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন সরকারি সূত্র। তবে হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে তাদের তিন হাজার কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য এ পর্যন্ত হতাহতের সুনির্দিষ্ট কোন তালিকা বা তথ্য দিতে পারেনি সংগঠনটি। রাতের ওই অভিযান নিয়ে নানামুখী গুজব ছড়াচ্ছে চারদিকে। শাপলা চত্বরে অভিযানের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা-বিবৃতি দেয়া হয়নি। সরকারি দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে শাপলা অভিযানে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে লাশের ছবি ছাপা হচ্ছে। কেউ সঠিক কোন সংখ্যা জানাতে পারছে না। শাপলা চত্বরের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকার বাইরে। মঙ্গলবার ঢাকার বাইরে তিনটি জেলায় সহিংসতায় অন্তত ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। নিহতদের কেউ হেফাজতের কর্মী। আবার কেউবা সাধারণ মানুষ। পুলিশ, বিজিবি এবং সেনা সদস্যও আছেন হতাহতের তালিকায়। গতকালও চট্টগ্রামে একটি ট্রেনের পাঁচটি বগি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। আজ থেকে শুরু হচ্ছে ১৮ দলীয় জোটের দুই দিনের হরতাল। হরতালে হেফাজতে ইসলাম সমর্থন দিয়েছে। আগামী রোববার আলাদাভাবে হরতাল ডেকেছে হেফাজত। সে হরতালে সমর্থন দিয়েছে ১৮ দল। গুমোট পরিস্থিতির মধ্যেই তিন দিনের এ হরতাল নিয়ে জনমনে নানা শঙ্কা। গতকাল রাত থেকেই বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে। হেফাজতের অবরোধের কর্মসূচির দিন থেকে সরকারি দলের কর্মীরা রাজপথে নেমেছেন। ওইদিন সকালে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে সরকারি দলের কর্মীরা দফায় দফায় জড়িয়েছেন। সহিংসতা এড়াতে হরতালেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। অবস্থান, পাল্টা অবস্থানে আবার নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। তবে তারা গতকাল চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, সরকার ১৩ দফা না মানলে পরিস্থিতি কি হবে তা বলা যাচ্ছে না। ঢাকায় সহিংসতার ঘটনায় ১৬টি মামলা করা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে লক্ষাধিক। নারায়ণগঞ্জের সহিংসতার ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীসহ ৪০ জন নেতাকর্মীকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ৫ই মে’র সহিংসতায় ১৬ মামলা
আসামি ‘অজ্ঞাতনামা অগণিত’
স্টাফ রিপোর্টার নূরুজ্জামান জানান, ৫ই মে’র সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর তিন থানায় ১৬ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা তিনটি। এসব মামলায় প্রায় ৪৯৫ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও আসামি করা হয়েছে ‘অজ্ঞাতনামা অগণিত’ ব্যক্তিকে। হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি আসামির তালিকায় আছেন বিরোধীদলীয় জোটের অনেক শীর্ষ নেতাও। ইতিমধ্যে এসব মামলার আসামি হিসেবে ২২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ঢাকা অবরোধ ও শাপলা চত্বরে সমাবেশ কর্মসূচি পালনের নামে হেফাজতে ইসলাম ও কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায় মতিঝিল ও পল্টন এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এছাড়া বিস্ফোরক দ্রব্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নগরজীবনে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মতিঝিল, পল্টন ও রমনা থানায় বিভিন্ন ধারায় ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পুলিশ জানায়, ৫ই মে হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার ঘটনায় মতিঝিল থানায় ৬টি, পল্টন থানায় ৯টি ও রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মতিঝিল থানায় দু’টি (মামলা নম্বর-১৩, ১৪) ও পল্টন থানায় একটি (মামলা নম্বর-৭) হত্যা মামলা হয়েছে। সব মামলা হয়েছে গত ৬ই মে। পুলিশের পাশাপাশি এসব মামলার বাদী হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ (সিপিবি), ঢাকা সিটি করপোরেশন (দক্ষিণ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ট্রাফিক পুলিশ (পূর্ব), আনসার-ভিডিপি ও যুবক কমিশন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল আহমেদ মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ঢুকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতি করেছে। পল্টন থানার ৭ নম্বর মামলার এজাহারে বাদী রেজাউল করিম উল্লেখ করেছেন, আমার স্ত্রীর বড় ভাই নাহিদ (২২)-কে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ পর্যায়ের ৩৩ নেতার নির্দেশে পিটিয়ে হত্যা করেছে। হত্যার পর নিহতের পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। ওই আসামিরা হচ্ছেন- জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি মাওলানা মো. রফিকুল ইসলাম, হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী, ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল জব্বার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখা হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফরিদ উল্লাহ, নায়েবে আমীর তাজুল ইসলাম, আবদুল মালেক হালিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামবাদী, আসানুল কারি ফজলুল করিম জিহাদী, মুফতি হারুন ইজাহার, মাওলানা ইলিয়াস ওসমানী, মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী, মাওলানা মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মাহফুজুল হক (শায়খুল হাদিসের ছেলে), আবদুল কুদ্দুস, নূরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত আমিনী, মোস্তফা আজাদ, মুফতি নুরুল আমিন, মাওলানা শাখাওয়াত হোসেন, মাওলানা জানায়েদ আল হাসিব, মাওলানা আতাউল্লাহ আমিম, মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন একরাম, শেখ লোকমান হোসেন, মুফতি শায়দুল ইসলাম, মোহাদ্দেস রুফকুল ইসলাম মাদানী, মুফতি শামসুল হক, মুফতি মনির হোসেন মুন্সী ও নারায়ণগঞ্জ থানার আহ্বায়ক আলহাজ মাওলানা আবদুল কাদের। এছাড়া মতিঝিল থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় বিএনপির সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আজিজুল বারী হেলাল ও সাইফুল ইসলাম নীরবসহ অজ্ঞাতনামা হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। মতিঝিল থানা পুলিশ সূত্রমতে, মতিঝিল থানার ৯ নম্বর মামলায় ৬ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত এক হাজার, ১০ নম্বর মামলায় অজ্ঞাত ৫০০-৬০০, ১১ নম্বর মামলায় ২৩৭ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাতনামা ৩-৪ হাজার, ১২ নম্বর মামলায় ২৩৭ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত ৩০-৪০ হাজার, ১৩ নম্বর মামলায় ২৪৭ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত কয়েক হাজার ও ১৪ নম্বর মামলায় ২৩৭ জনের নাম উল্লেখ সহ আরও ৩০-৪০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। পল্টন থানা পুলিশ সূত্রমতে, পল্টন থানায় দায়ের করা ৯ মামলার মধ্যে ৭ নম্বর মামলায় ৩৪ জনের নাম উল্লেখসহ অসংখ্য অজ্ঞাতনামা, ৮ নম্বর মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার, ৯ নম্বর মামলায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত কয়েক শ’, ১০ নম্বর মামলায় ১৪ জন সহ অজ্ঞাত কয়েক শ’, ১১ নম্বর মামলায় ১৯৪ জন সহ অজ্ঞাত ১০-১২ হাজার, ১২ নম্বর মামলায় ১৯৪ জন সহ অজ্ঞাতনামা ১০-১২ হাজার, ১৩ ও ১৪ নম্বর মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা অগণিত’ ১৫ নম্বর মামলায় ৬জন সহ ৪-৫ হাজার এবং রমনা থানায় দায়ের করা ১০ নম্বর মামলায় আজ্ঞাতনামা এক হাজার থেকে ১২শ’ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলে নাশকতা
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, চট্টগ্রাম রেলের সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের ৫ বগিতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতে নগরীর বটতলী স্টেশনে কে বা কারা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় আড়াই কোটি টাকার সম্পদ। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দু’জনকে আটক করা হয়েছে।
বরখাস্ত করা হয়েছে প্রশাসনিক ৪ কর্মকর্তাকে। যাত্রীরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের পদত্যাগ দাবি করেছেন। বলেছেন, এভাবে ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ বেড়েছে। যাত্রীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন। এব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে রেলমন্ত্রী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের দু’জন কর্মকর্তা জানান, গতকাল ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনাটি ঘটে। এই সময় স্টেশন চত্বরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। বেশির ভাগ প্রহরী ছিলেন ঘুমিয়ে। লোকজনের চলাচল ছিল কম। এই সুযোগে ৮-১০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল পুরাতন স্টেশন দিয়ে ঢুকে পড়ে।
এর একটু আগে নগরীর পাহাড়তলী ডক ইয়ার্ড থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের অত্যাধুনিক বগিগুলো ইঞ্জিনে লাগানোর জন্য আনা হয়। সারি সারি ভাবে রাখা ১১টি ইঞ্জিনের ৫টিতেই কৌশলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে দুর্বৃত্তরা। এরপর তারা বগির ভেতরে যাত্রীদের বসার সব ক’টি সিটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত নেমে পড়ে।
যাওয়ার আগে বগিগুলোর দরজা-জানালা ভেঙে তছনছ করা হয়। প্রায় আধাঘণ্টা পর বগির ভেতর থেকে ধোঁয়া দেখে ছুটে আসেন রেলের সকালবেলার দায়িত্বরত কর্মচারীরা। তারা বিষয়টি স্টেশন ম্যানেজারকে জানান। পরে তিনি ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন। কিন্তু তাদের দু’টি টিম ঘটনাস্থলে আসার আগেই মূল্যবান সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সকাল সাড়ে ৭টায় কথা হয় চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ম্যানেজার শামসুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের বেশ কয়েকটি বগিতে কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ৩টি বগিতে কিছু নেই। বাকিগুলোর বেশির ভাগই পুড়ে গেছে। নির্ধারিত সময় যেহেতু ৭টায় ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল এখন আর তা হচ্ছে না। একটু সময় লাগছে। তবে ট্রেন অবশ্যই ঢাকায় যাবে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার ঘটনায় যাত্রীদের মনে ভয় ঢুকে যায়। তাদের বেশির ভাগ টিকিট ফেরত দিয়ে বাড়ি ফিরে যান। অনেকে বাসে যাওয়ার জন্য রওনা করেন। প্রায় একঘণ্টা পর সুবর্ণ এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ে। এই সময় কর্তৃপক্ষ নতুন দু’টি বগি ডক থেকে এনে সেখানে মূল ইঞ্জিনের সঙ্গে সংযোজন করে। নির্ধারিত সময়ে যাত্রীরা ঢাকায় পৌঁছতে না পেরে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এই যদি হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাহলে চলন্ত ট্রেনে যাত্রীরা আগুনে পুড়ে মরবে।’ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্র জানায়, যাত্রীদের ক্ষোভের মুখে রেলমন্ত্রী দ্রুত স্টেশন মাস্টার মাহবুবুর রহমানসহ ৪ জনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন। অন্য তিনজন হলেন- রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর হাবিলদার মঞ্জুরুল আলম, স্টেশনের প্রহরী জসিম উদ্দিন ও রায়হান।
ঘটনা খতিয়ে দেখতে দুপুরে রেল কর্তৃপক্ষ ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেন। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেন্ডেন্ট মিয়া জাহানকে। কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটি গঠনের কথা সত্য বলে জানান পূর্ব রেলের জিএম তাফাজ্জল হোসেন। এই বিষয়ে সন্ধ্যায় মানবজমিনকে তিনি ফোনে বলেন, ‘পুরো ঘটনাটি শুরু থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিভাবে হলো, কারা করলো, লোকজন কোথায় ছিল সবকিছুই দেখবে তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এখন পর্যন্ত ৪ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে কমিটি।’
জিআরপি পুলিশ জানায়, রেলে নাশকতা ঘটানোর সময় দু’জনকে আটক করা হয়েছে। এরা হলেন- আজগর আহমেদ এহসান (২৩) ও মিঠু মিয়া (২৫)। তারা দু’জনেই ছাত্র বলে জানান থানার ওসি। এই বিষয়ে কথা হয় ওসি আহসান হাবিবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যাদের ধরেছি তারা একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী বলে জানতে পেরেছি। মামলায় তাদেরকে আসামি করা হবে। তাদের সঙ্গে আরও ৭/৮ জন মিলে এই নাশকতার ঘটনায় অংশ নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজগর আহমেদ এহসান-এর বাড়ি চাঁদপুর সদরে। আর মিঠু মিয়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর ফকিরনির হাট এলাকায় থাকেন।’
জিআরপি থানার এএসআই নুরুল হক বলেন, ‘যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আমরা যাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা যাবে না।’
নারায়ণগঞ্জে হেফাজত-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় ৪ মামলা
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত আরেক বিজিবি সদস্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। নিহতের নাম লাভলু। এ নিয়ে ওই সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১৯-এ। এদিকে সোমবারের সংঘর্ষ, কাঁচপুর হাইওয়ে থানাসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় ৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওইদিন রাতে এ মামলাগুলো করা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে ৩টি ও অপর মামলাটি করেছেন হেফাজত কর্মীদের পুড়িয়ে দেয়া এক বাসের মালিক। সবগুলো মামলাই ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা অসংখ্য আসামি করা হয়।
থমথমে নারায়ণগঞ্জ: এদিকে সোমবারের সংঘর্ষের পর থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র। গ্রেপ্তার আতঙ্কে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বস্থানীয়রা গা-ঢাকা দিয়েছেন। যারা আছেন তাদের মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ মাদরাসা, আমলাপাড়া মাদরাসা, চাষাঢ়া বাগে জান্নাত মাদরাসা, ফতুল্লার শাহ ফতুল্লা মাজার সংলগ্ন মাদরাসাসহ ফতুল্লা, বন্দর, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সিদ্ধিরগঞ্জের কওমী মাদরাসাগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে ভীতির ছাপ। গ্রেপ্তারের ভয়ে ওই সব মাদরাসার অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এছাড়া, হেফাজতে ইসলামের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাশারীর ঐতিহাসিক মাদানীনগর মাদরাসায় সুনশান নীরবতা চলছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতৃত্বস্থানীয়রা মাদরাসা থেকে চলে গিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। মাদরাসার চারপাশে নিমাইকাশারী, বাঘামারা, সানারপাড়, আটি, পাইনাদী নতুন মহল্লা, ধনুহাজী রোড, রসুলপুর, বকশনগর এলাকায় সাধারণের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
লুট হওয়া শটগানের পার্টস উদ্ধার: এদিকে সোমবার হেফাজতকর্মীদের সঙ্গে মাদানীনগর এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলাকালে বিজিবি’র এক সদস্যের কাছ থেকে লুট হওয়া শটগানের মেকানিজম ও প্লেজারগার্ড উদ্ধার করেছে র্যাব। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাশারী এলাকার বায়তুল মামুর জামে মসজিদের সামনের জলাশয় থেকে এসব পার্টস উদ্ধার করা হয়। অভিযানের নেতৃত্ব দেন র্যাব-১১ আদমজী ক্যাম্পের মেজর আশরাফ, লেফটেন্যান্ট রাসেল আহমেদ খান ও সার্জেন্ট শাহীন। সোনারগাঁয়ে ৪ মামলা: সোমবারের ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সোনারগাঁ থানায় ৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলার বাদী পুলিশ ও একটির বাদী পরিবহন মালিকপক্ষ। সোমবার গভীর রাতে মামলাগুলো করা হয়।
পুলিশ জানায়, পুলিশের ওপর হামলা, মারধর, জখম, খুন ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে সোনারগাঁ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা অনেককে আসামি করা হয়েছে।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগে কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল ইমতিয়াজ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা বহু মানুষকে আসামি করা হয়।
তৃতীয় মামলাটি করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হাবিলদার জুলহাস মিয়া। এ মামলায় কাঁচপুর বালুরমাঠে ডিএমপির ডাম্পিং করে রাখা অবৈধ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এ মামলায় কোন আসামির নাম সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়নি। চতুর্থ মামলাটি করা হয় বাস পোড়ানোর ঘটনায়। পরিবহন মালিকের পক্ষে জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা বহু লোককে আসামি করে মামলাটি করেন।
সোনারগাঁ থানার ওসি আতিকুর রহমান খান জানান, সোমবারের সহিংস ঘটনায় মামলাগুলো করা হয়েছে। তবে এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
উল্লেখ্য, সোমবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাছ ফেলে, টায়ারে ও রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে হেফাজতের কর্মীরা। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারদলীয় লোকজনের সঙ্গে হেফাজতের কর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হয়। এরমধ্যে ২ জন বিজিবি ও ২ জন পুলিশ সদস্য রয়েছে। বিক্ষুব্ধ হেফাজত কর্মীরা কাঁচপুর ফাঁড়ি ও কাঁচপুর হাইওয়ে থানায় হামলার পর কাঁচপুর হাইওয়ে থানায় আগুন দেয়। কাঁচপুর থেকে সানারপাড় পর্যন্ত মহাসকের বিভিন্ন পয়েন্টে র্যাব ও পুলিশের দু’টি পিকআপ ভ্যানসহ ৩০/৩৫টি গাড়িতে আগুন দেয়। ভাঙচুর করে শতাধিক গাড়ি।
বিএনপি’র গায়েবানা জানাজা: এদিকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ বিএনপি বিশেষ দোয়া ও গায়েবানা জানাজা পালন করেছে। বিকালে শহরের ডিআইটি জামে মসজিদ এলাকায় জেলা বিএনপির কার্যালয়ে শহর বিএনপির আয়োজনে অনুষ্ঠিত এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল, আনোয়ার মাহমুদ বকুল, জান্নাতুল ফেরদৌস, আনোয়ার হোসেন খান প্রমুখ।
সৌজন্য: মানবজমিন
Leave a Reply