মুহাম্মদ ইউনূস: সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক। রানা প্লাজায় ফাটলের পর ভবনধস দেখিয়ে দিল আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে। রানা প্লাজায় মৃতদের আত্মা আজ আমাদের কর্মকাণ্ড দেখছে, আমাদের আলোচনা শুনছে। আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস আমাদের সর্বক্ষণ ঘিরে আছে।এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড থেকে আমরা কি কিছু শিখলাম? নাকি শুধু মর্মান্তিক বেদনা জানিয়ে আমাদের কর্তব্য শেষ করব।
আমাদের করণীয় কী?
ক) এ ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে কোনো দিন পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য কী কী করতে হবে।
খ) যারা প্রাণ হারাল, অঙ্গ হারাল, আয় হারাল তাদের জন্য আমাদের করণীয় কী?
গ) পোশাকশিল্পকে শুধু রক্ষা নয় বরং শক্তিশালী করার জন্য আমাদের কী করতে হবে।
ঘ) সাভারে শুধু শুধু ভবন ধসে পড়েনি। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ার একটি বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এ ভবন ধসে পড়েছে। ভবনধসের বিশ্লেষণ করলে আমাদের ধসে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা ধরা পড়বে। এ ধস থামাবার উপায় বের করতে হবে।
পোশাকশিল্পকে রক্ষা তো বটেই বরং শক্তিশালী করা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ গঠন
ক) পোশাকশিল্প সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছে। বাংলাদেশে পোশাক তৈরি করতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলে বিদেশী একটি বিশাল ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ দেশ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এরপর আরো অনেকে তার দৃষ্টান্ত অনুকরণ করে এদেশ থেকে চলে যেতে পারে। এটা যদি হয়, তা আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যেক প্রচণ্ডভাবে আঘাত করবে। এ শিল্প শুধু আমাদের আয় বাড়াচ্ছে না, আমাদের নারী সমাজকে সম্পূর্ণ নতুন জীবনের সন্ধান দিয়ে সমাজে বিরাট পরিবর্তন এনেছে।
এ শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেয়া যাবে না। বরং শক্তিশালী করার জন্য সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ হতে হবে। সরকার, পোশাকশিল্পের মালিক, এনজিও, নাগরিক সমাজ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশী ক্রেতাদের পরিপূর্ণভাবে আশ্বস্ত করতে হবে, তারা যাতে আর কখনো আমাদের কারণে বিপাকে না পড়ে সে ব্যাপারে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে আমরা একতাবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে আমাদের অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে পালন করব।
খ) এদের প্রত্যেকে (সরকার, মালিকপক্ষ, নাগরিক সমাজ প্রভৃতি) যৌথভাবে যেমন কাজ করবে, তেমনি নিজ নিজ আওতায় স্বতন্ত্রভাবেও কাজ করে যাবে। নাগরিক সমাজকে নিজস্ব পদ্ধতিতে কর্মসূচি নিতে হবে। নাগরিক সমাজ দেশের পক্ষ থেকে
বিদেশী ক্রেতাদের মনে আস্থা এবং আশা সৃষ্টির প্রয়াস নিতে পারে। তারা অবিলম্বে যৌথভাবে স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ক্রেতা কোম্পানিগুলোর বোর্ড চেয়ারম্যান এবং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠাতে পারে। বক্তব্য বিষয় হবে: বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা, নারীদের ক্ষমতায়নে এবং বাংলাদেশের ব্যাপক পরিবর্তনে এর ভূমিকা তুলে ধরে তাদের ধন্যবাদ জানানো। পোশাক শিল্পের যাবতীয় সমস্যা মেটাতে সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে এবং পৃথকভাবে নাগরিক সমাজ প্রস্তুত হয়েছেন এটা জানানো, এ ব্যাপারে যেসব কর্মসূচি নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছেন সেটা জানানো, তাদের কর্মসূচি নিয়ে বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটা ‘সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ ফর প্রটেক্টিং গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ বা অনুরূপ নামে যে একটা প্রতিষ্ঠান গঠন হয়েছে, সেটা এবং এর পরিচিতি তাদের জানিয়ে দেয়া প্রভৃতি।
গ) আরেকটি চিঠি যাবে বিদেশী সংগঠন, এনজিও, কনসাল্টিং ফার্মের কাছে; যারা তৃতীয় বিশ্বের পোশাকশিল্পের মান উন্নয়ন, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা, মনিটরিং, স্ক্রিনিং প্রভৃতি নিয়ে কাজ করেন তাদের কাছে। অ্যাকশন গ্রুপ তাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়, তাদের সহযোগিতা চায়— এটা জানিয়ে দেয়া। তাদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানানো এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করা।
ঘ) ক্রেতা দেশগুলোর সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লেখা— আমরা পোশাকশিল্পের ব্যাপক পরিবর্তন আনতে বদ্ধপরিকর সেটা জানিয়ে দেয়া।
ঙ) দেশের অভ্যন্তরে সরকার, শিল্পমালিক, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, শ্রমিক সংগঠন, এনজিও, বায়িং হাউস, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দেয়া এবং কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে বৈঠক করা।
অ্যাকশন গ্রুপ নিয়মিতভাবে সরকার, বিদেশী ক্রেতা, শিল্পমালিক, পোশাক শ্রমিক ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে পোশাকশিল্পের সম্প্রসারণ এবং পোশাক শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পোশাকশিল্প নিয়মিত মনিটর করবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের পরামর্শ দেবে, সংবাদমাধ্যমকে অবহিত রাখবে এবং কর্মসূচি নেবে। তারা হবে নাগরিক ওয়াচ ডগ প্রতিষ্ঠান।
শ্রমিকদের ব্যাপারে আমার দুটি প্রস্তাব
পোশাকশিল্পের সমস্যা সমাধানে কিছু প্রস্তাব ক্রেতাদের কাছে মাঝে মাঝে দিয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রস্তাব এখন আবার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তুলে ধরতে চাই। বিশেষ করে পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ‘ক্রীতদাস তুল্য শ্রমিক’ ঘোষণা দেয়ার পর আমার প্রস্তাবটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ মঙ্গলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।
ক) আমার প্রথম প্রস্তাবটি এ রকম:
দেশে ন্যূনতম মজুরি আইন আছে। যার ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান এর নিচে বেতন দিলে সেটা বেআইনি প্রতিপন্ন হয়।
আমার প্রস্তাব হলো: পোশাকশিল্পের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক ন্যূনতম বেতন স্থির করে দেবে। বাংলাদেশে সর্বনিম্ন বেতনের হার যদি এখন ঘণ্টায় ২৫ সেন্ট হয়ে থাকে, এটাকে আন্তর্জাতিক শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিক মানের করে সর্বনিম্ন ৫০ সেন্ট নির্ধারণ করে তারা সব দরদাম নির্ধারণ করবে। কোনো ক্রেতা এর নিচে বেতন ধরে পোষাকের দর নির্ধারণ করবে না, কোনো গার্মেন্টশিল্পমালিক এর নিচে বেতন ধার্য করবে না। এটা কমপ্লায়েন্সের একটা অঙ্গ হবে। এর একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন ধারণা করাই স্বাভাবিক। এতে বাংলাদেশ ‘সস্তা’ শ্রমিকের জন্য যে পরিমাণ আকর্ষণীয় হতে পেরেছিল, সেটি রাতারাতি হারিয়ে ফেলবে। এ আকর্ষণ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশকে অন্যান্য দিক থেকে আকর্ষণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যেমন শ্রমিকপ্রতি উত্পাদনের হার বাড়ানো, অন্য সব দিক থেকে কর্মদক্ষতা বাড়ানো, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ আস্থা অর্জন করা, কোনোরূপ বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না হয় তার নিশ্চয়তা দেয়া, শ্রমিক মঙ্গল সর্বাঙ্গীনভাবে নিশ্চিত করা প্রভৃতি।
এ আন্তর্জাতিক ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত পোপের মর্মান্তিক উক্তি ‘ক্রীতদাস তুল্য’ অবস্থান থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের পোশাক ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের নিষ্কৃতি দিতে পারবে না।
বিভিন্ন ক্রেতাদেশের রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী নেতা, নাগরিক গোষ্ঠী, চার্চ গ্রুপ এবং মিডিয়ার সঙ্গে আন্তরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে সমর্থন অর্জন করতে হবে। এ ব্যাপারে অতীতে চেষ্টা চালিয়েছি। সাভার ট্র্যাজেডির পর এবং পোপের ধিক্কারের পর আবার সুযোগ এসেছে বিষয়টি তুলে ধরার। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমার এ চেষ্টাকে আরো জোরদার করব, এ অঙ্গীকার করছি।
আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোঝাতে হবে, পোশাকশিল্পের শ্রমিক বাংলাদেশে বসে কাজ করলেও তারা তাদের দেশের জন্যই শ্রম দিচ্ছে। তারা ওই দেশেরই ব্যবসার স্টেকহোল্ডার। এসব শ্রমিকেরই শ্রমে তাদের ব্যবসা। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে তাদের থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন, সেটা হয় না। সেখানেই পোপের বক্তব্যের মূল ম্যাসেজ। এটা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বুঝতে হবে। আন্তর্জাতিক কনজিউমারদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে সব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে একমত করতে হবে— এমন হওয়ারও দরকার নেই। কয়েকটি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে এগিয়ে এলেই কাজটা শুরু হয়ে যাবে। অন্যরাও ক্রমে ক্রমে এটা মেনে নেবে।
খ) দ্বিতীয় প্রস্তাবটি অনেক দিন ধরে অনেকের কাছে দিয়েছি। কিন্তু দানা বাঁধেনি। এখন আবার নতুন করে বলার এবং বাস্তবায়নের সুযোগ দেখা দিয়েছে।
আমরা যে পোশাক ৫ ডলার দাম ধরে সুন্দর মোড়কে পুরে চমত্কার কার্টনে ভরে নিউইয়র্ক বন্দরে পৌঁছে দিই, সেই পোশাকের পেছনে তুলা উত্পাদনকারী কৃষক থেকে তুলা প্রক্রিয়াজাত, পরিবহন, সুতা বানানো, কাপড় কেনা, রঙ করা, জামা তৈরি করে সুন্দর মোড়কে কার্টনে ভরে নিউইয়র্ক বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যেতে যত শ্রম, ব্যবস্থাপনার মেধা এবং কাঁচামাল লেগেছে, বিভিন্ন স্তরে মালিককে যা লাভ করতে হয়েছে, তার সবকিছু এ ৫ ডলারের মধ্যে নিহিত আছে। আমেরিকার কোনো বিপণিকেন্দ্র থেকে যখন একজন আমেরিকান ক্রেতা এটা ৩৫ ডলার দামে এটা কিনে সস্তায় কেনার আনন্দ উপভোগ করেন; তখন মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, এ বণ্টনব্যবস্থায় সামান্যতম পরিবর্তনও কি করা যায় না? উত্পাদন যারা করল, তারা সবাই মিলে পেল ৫ ডলার, বিক্রি করতে গিয়ে যোগ হলো আরো ৩০ ডলার। বিক্রিমূল্যটা সামান্য একটু বাড়ালেই শ্রমিকদের জন্য অনেক কল্যাণমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় এবং উত্পাদন ও বাজারজাত করার মধ্যেও কিছুটা সঙ্গতি আসে। এ সঙ্গতি আনতেই আমার প্রস্তাব।
আমার প্রস্তাব হলো: ৩৫ ডলারের জামাটিকে যদি ৩৫ ডলার ৫০ সেন্টে কিনতে বলি তাতে ক্রেতা কি খুবই বিচলিত বোধ করবে? এ অতিরিক্ত ৫০ সেন্ট দিয়ে যদি আমি উন্নত বিশ্বের কনজিউমারদের কাছে পরিচিত এবং আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় বাংলাদেশে একটি ‘গ্রামীণ বা ব্র্যাক পোশাকশিল্প শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করতে পারি, শ্রমিকের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় এতে। তার শারীরিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, অবসরকালীন নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সন্তানের দেখাশোনা, উপার্জন, ভ্রমণ সবকিছুই এর মাধ্যমে করা সম্ভব।
এর জন্য কী করতে হবে? পোশাকের যে দাম দরকষাকষির মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে, তার ভিত্তিতে উত্পাদন চুক্তির যে মূল্যমান দাঁড়াবে, তার ওপর ১০ শতাংশ অর্থ আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জমা দেবে আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গঠিত ‘শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্টে’— শুধু ওই কারখানার শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য। কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে প্রত্যেক কারখানার জন্য পৃথক পৃথক উপ-তহবিল থাকবে যাতে প্রত্যেক কারখানার উত্পাদনের জন্য স্ব স্ব কারখানার শ্রমিকরা সরাসরি উপকৃত হয়।
বাংলাদেশ যদি বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করে আর সব ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি এ প্রস্তাব মেনে নেয় তবে এ তহবিলে প্রতি বছর ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার জমা পড়বে। ফলে ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন শ্রমিকের প্রত্যেকের জন্য বছরে ৫০০ ডলার করে কল্যাণ তহবিলে জমা হবে। এরকম অর্থ সংগ্রহ করা গেলে এবং তা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা গেলে শ্রমিকদের অনেক দুঃখ লাঘব হবে। অন্যান্য দেশের জন্যও এটা একটা দৃষ্টান্ত হবে। শুধু ৩৫ ডলারের জামাটি ৩৫ ডলার ৫০ সেন্টে বিক্রি করলেই অনেক সমস্যা মিটে যায়।
কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি বলে এতে আমার বিক্রি বা লাভ কমে যাবে, তাদের বলব— এর জন্য যাতে আপনার বিক্রি না কমে, বরং যাতে বাড়ে, সে ব্যবস্থাও করা যায়। আপনার জামায় আমরা একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেব: এতে লেখা থাকবে From the Happy Workers of Bangladesh, with Pleasure. Workers’ wellbeing being Managed by Grameen অথবা BRAC অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে সুন্দর একটা লোগো থাকবে, দেখলেই বুঝতে হবে এ কারখানার শ্রমিকরা অত্যন্ত আনন্দ ও উষ্ণতার সঙ্গে এ জামা তৈরি করে দিয়েছে। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করতে অতি পরিচিত এবং আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এটা তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহারও করতে পারবে। একজন কনজিউমার জামাটি কিনতে গেলেই বুঝতে পারবে এ পণ্যটি কেনার মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক সুস্থ-সুন্দর জীবনের অধিকারী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। বিক্রেতা কোম্পানির ওয়েবসাইট ও বার্ষিক রিপোর্ট থেকে যেকেউ জানতে পারবেন তার কেনা জামা তৈরি কারক শ্রমিকদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দেয়া হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে করা হচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এতে ওই জামার বিক্রি বাড়বে, কমবে না।
শ্রমিকরা যে তাদের পরিবারের অংশ, এটা দেশী এবং বিদেশী ব্যবসায়ীদের অনুভব করতে হবে। আগের মতো ‘ক্রীতদাস তুল্য’ শ্রমিকের দিন শেষ হয়ে যেতে হবে।
আমার প্রস্তাবের সঙ্গে সব ক্রেতা প্রতিষ্ঠান একমত হয়ে যাবে— এমন আশা করছি না। আশা করছি, দু-একটি প্রতিষ্ঠান এটা পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে আসবে। তাদের দেশের সরকার ও শ্রমিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো, নাগরিক গোষ্ঠী, চার্চ গ্রুপ এটা সমর্থন করতে এগিয়ে আসবে।
সাভারের গণমৃত্যুর প্রেক্ষাপটে এবং পোপের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরো জরুরিভাবে সব পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
পোশাকশিল্প বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়াটা আমাদের কাছে যেমন দুঃখজনক হবে, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও সমান দুঃখজনক হওয়া উচিত বলেই মনে করি। যে দেশ তাদের ব্যবসার কারণে গভীরভাবে উপকৃত হতে পারত, যে দেশে তাদের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলো দ্রুত চোখে পড়ার মতো সম্ভাবনা সব চাইতে বেশি; সে দেশে কাজ করাটা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে আনন্দদায়ক হওয়ারই তো কথা। যে দেশ তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারত, সে দেশ থেকে চলে যাওয়ার মধ্যে কোনো সুখ নেই। সরকার ও নাগরিকরা যদি একজোট হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের যাবতীয় অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য এগিয়ে আসে, তখন তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা দেশের নতুন ভবিষ্যত্ গড়ার মধ্যেই থাকবে নতুন প্রজন্মের ব্যবসার আনন্দ। আমরা এ আনন্দ তাদের দিতে চাই। এ আনন্দ উপভোগ করতে তারা এগিয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। শুধু যে ডিজনি চলে গেছে, তাদের ফিরিয়ে আনব না, বরং যারা এখানে এখনো আসেনি, তাদেরও এখানে আসার জন্য আগ্রহী করে তুলব আমরা। বিশ্বের ব্যবসার জগতে পরিবর্তন আসছে। এখনো পরিবর্তনটি ক্ষীণ হলেও সেটা আসছে। আমরা সে পরিবর্তনকে বেগবান করতে পারি। আমাদের কর্মকাণ্ড এবং তার ফলাফল সেই ভিত্তি তৈরি করে দিতে পারে।
সাভারে যত লোক প্রাণ হারিয়েছে, যাদের অঙ্গহানি হয়েছে, যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ তাদের একটা পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেস তৈরি করতে পারে এবং ক্রমাগতভাবে আপডেট করে যেতে পারে। এর প্রাথমিক কাজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে করার উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছে। অ্যাকশন গ্রুপ এটা সমন্বয় করার দায়িত্ব নিতে পারে।
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এ পর্যন্ত অনেক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, অনেক অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, এর সর্বোত্তম বাস্তবায়ন কীভাবে হতে পারে এ ব্যাপারে অ্যাকশন গ্রুপ পরামর্শ দিতে পারে। কর্মসূচি মনিটর করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারে। ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে ব্যক্তিপর্যায়ে যোগাযোগ রেখে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে সঠিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দিতে পারে।
সাভারের কারণে সৃষ্ট অসংখ্য পরিবারের সমস্যা নানাবিধ— তাত্ক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। বিভিন্ন মেয়াদের, বিভিন্ন ধরনের (স্বাস্থ্য, উপার্জন, লেখাপড়া প্রভৃতি) সমস্যা সমাধানে কার্যকর কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসার ব্যাপারে দেশবাসীকে উদ্যোগী রাখার জন্য অ্যাকশন গ্রুপকে প্রস্তুত হতে হবে।
আমাদের কি বোধোদয় হবে না?
সাভার জাতির মনে গভীর বেদনা ও বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এ বেদনা ও ক্ষত যেন আমাদের জাতীয় জীবনের মূল সমস্যা সমাধানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলে এ কামনা করছি। সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের অপরাজনীতির সৃষ্টি। অপরাজনীতি যে আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে, সেটা টেলিভিশনের পর্দার সামনে সাভারে অর্ধ সহস্রাধিক অসহায় মৃত্যু, বহু শত মানুষের অঙ্গহানি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তার পরও কি আমরা সবকিছু মেনে যাব? আমাদের কি বোধোদয় হবে না?
Leave a Reply