মহিউদ্দীন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে: জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে নিয়ে জোর গুঞ্জন চট্টগ্রামে। গত কয়েক দিন ধরে তাকে হেফাজত নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। তিনি ঘন ঘন তার মাদরাসায় যাচ্ছেন। দেখা করছেন। কথা বলছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তাকে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। অভয়ের কথাও শোনাচ্ছেন।
তার এসব কর্মকাণ্ড রাজনৈতিকসহ সচেতন মহলে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। গুঞ্জন উঠেছে- তিনি সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। সরকারের উচ্চ মহল থেকেই তাকে আল্লামা শফীকে ম্যানেজ করার কথা বলা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আল্লামা শফীর সঙ্গে একাধিকবার দেখা করার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। কিন্তু সরকারের পক্ষ হয়ে সমন্বয় করার চেষ্টার বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাটহাজারী মাদরাসার একাধিক সূত্র জানান, ঢাকার শাপলা চত্বরের ঘটনার পর মহাজোট শরিক দলের কাছে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কদর অনেকখানি বেড়েছে। বিশেষ করে ৫ই মে-র পর আল্লামা শফী চট্টগ্রামে চলে এলে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির অন্যতম এ নীতিনির্ধারক।
ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনায় সেখানে বক্তব্য দিতে পারেননি হেফাজত আমীর। ঢাকা থেকে বিমানে তাকে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয় সরকারের লোকজন।
চট্টগ্রামে তার আসার আগে সেদিন সকাল থেকেই উত্তেজনার সৃষ্টি হয় হাটহাজারী মাদরাসার আশপাশে। হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাদের মধ্যে ৩ জন হেফাজত কর্মী ছাড়াও সরকারের সেনা গোয়েন্দা বাহিনীর একজন সদস্যও রয়েছেন।
বিমানবন্দর থেকে নেমে আল্লামা শফী সরকারের প্রটেকশনে সোজা হাটহাজারী মাদরাসায় ঢুকে যান। এরপর থেকে তিনি নীরবতা পালন করছেন। দলের বাইরে কারও সঙ্গে কোন কথা বলছেন না। তার পক্ষ থেকে বক্তব্য দিচ্ছেন জুনিয়র নেতা-কর্মীরা। তবে মাদরাসার ভেতরে থেকে আবারও দলকে তিনি চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
হেফাজত নেতারা জানান, ঢাকা থেকে আসার পর আল্লামা শাহ আহমদ শফী একেবারেই আড়ালে চলে গেছেন। হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ধৈর্য ধরে সময় দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। নতুনভাবে সংগঠন গোছানোরও চেষ্টা করছেন। প্রতিদিনই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য হেফাজতের জেলা প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করেছেন। দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করে চলে যাচ্ছেন।
হেফাজতের নতুনভাবে উঠে দাঁড়ানোর এ চেষ্টায় সরকার কিছুটা ভীত বলে দাবি করেছেন সংগঠনের নেতারা। বলেছেন, আগের বার সরকারকে ছাড় দিয়ে তারা যে ভুল করেছেন এবার হয়তো তার পুনরাবৃত্তি হবে না। তাই এখন থেকে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিতে নতুনভাবে ছক কষছেন হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।
বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও তা ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের পুলিশ বাহিনীসহ উচ্চ মহলকে। গত ৬ই মে শফী হুজুর ঢাকা থেকে আসার পর এমপি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নিজে মাদরাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তারা প্রায় একান্তে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন।
এই সময় আল্লামা শফী তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা তো সরকারের লোক। পুলিশ দিয়ে এভাবে যে আমার দলের লোকগুলোকে মারলা সেটা কি ঠিক করলা?’ জবাবে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন ব্যারিস্টার আনিস। এরপর তিনি হুজুরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি যেহেতু এই এলাকার এমপি, তাই চাই না আপনার সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ুক। বর্তমান সরকার আপনাকে ভাল জানে। এই ভাল জানার বিষয়টি আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে দু’জনেরই লাভ। তাহলে আর এভাবে মানুষ মরতে হবে না।’ আল্লামা শফীকে এ সময় ব্যারিস্টার আনিস আরও বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
বলেছেন, বড় ধরনের কর্মসূচি দেয়ার আগে খানিক ভাবলে ভাল হবে। সরকার যেহেতু হার্ডলাইনে চলে গেছে তাই হেফাজতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানো ঠিক হবে না। ব্যারিস্টার আনিস সেখান থেকে চলে আসার তিনদিন পর গত ৯ই মে বিকালে আবারও সেখানে যান হুজুরের সঙ্গে কথা বলতে।
এ সময় হাটহাজারী মাদরাসায় হেফাজত নেতাদের বৈঠক চলছিল। ব্যারিস্টার আনিসকে দেখে হেফাজত নেতারা সালাম দিয়ে সরে যান। এরপর হুজুরের সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের সাহিত্য সম্পাদক আশরাফ আলী নিজামপুরী মানবজমিনকে বলেন, ‘হুজুরের কাছে কেবল ব্যারিস্টার আনিস সাহেব নন, মন্ত্রী হাছান মাহমুদ থেকে শুরু কয়েক ডজন লোক এসেছেন। তারা এসে কোন ধরনের কর্মসূচিতে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বলা যায়, সরকারের পক্ষ থেকেই তারা হেফাজতকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই চেষ্টা এখনও চলছে।’
হেফাজত নেতারা মনে করছেন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এর আগে ঢাকা অবরোধ কিংবা লংমার্চের কর্মসূচি থেকে তাদের বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। কেবল তাই নয়, তার সঙ্গে আসা চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুস সালামও হেফাজত নেতাকে শান্ত করতে পারেননি। তাই সরকারের উচ্চ মহল নতুন করে স্থানীয় এমপি ব্যারিস্টার আনিসকে মধ্যস্থতা করার জন্য বেছে নিয়েছেন।
অনেকের মতে, গত নির্বাচনে তার জয়ী হওয়ার পেছনে মাদরাসার আলেমদের বিশাল একটি অংশ ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে। বিষয়টি জানার পর সরকারই তাকে আল্লামা শফীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে খোলাখুলিভাবেই কথা বলেন হাটহাজারী আসনের নির্বাচিত এমপি ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মোবাইল ফোনে তিনি মানবজমিনকে বলেন, ‘আপনারা যেসব গুঞ্জন শুনছেন আমিও সেসব কথা শুনেছি। আমার কানে আসছে। আসলে সেরকম কিছু নয়। আমার নিজের এলাকায় হাটহাজারী মাদরাসা হওয়াতে দুশ্চিন্তা, চিন্তা দু’টোই আছে বলতে পারেন। তাছাড়া হুজুরকে আমি অনেক পছন্দ করি। তিনিও আমাকে পছন্দ করেন। তার সঙ্গে ঢাকা থেকে আসার পর আমার অনেক কথা হয়েছে। তাকে আমি বলেছি হাটহাজারীতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা আর হবে না। যেহেতু ইতিমধ্যে সেখানে বেশ কয়েকজন লোক মারা গেছেন।’
সরকারের সঙ্গে হেফাজতের দূরত্ব কমাতে আপনাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এখনই কোন কথা বলতে চাই না। কেন্দ্রীয়ভাবে দূরত্ব মীমাংসার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না। এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভাল।’
সৌজন্য: মানবজমিন
Leave a Reply