কাজী সোহাগ: ভাই আপনাদের বাঙালিদের চেনা বড়ই মুশকিল। এই শুনি আপনারা জীবনবাজি রেখে ট্র্যাজেডির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করছেন। জীবিত পেলে চোখে দেখা যাচ্ছে আনন্দ অশ্রু। আবার মৃত পেলে বেদনার জল। এ আপনারাই আবার রাতভোর তাণ্ডব চালাচ্ছেন। ভাঙছেন গাড়ি, আক্রমণ করছেন একে অপরকে। গুজব ছড়াচ্ছেন হাজার মানুষের মৃত্যুর। কথাটি একজন ভারতীয় সাধারণ নাগরিকের। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত কাজে কয়েক দিনের জন্য গিয়েছিলাম কলকাতায়। সেখানে বাসে পরিচয় তার সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই তার ওই মন্তব্য। তার এ মন্তব্য যে নিছক নয় তা আমরা সবাই জানি। মানি। আবেগপ্রবণ বাঙালির চেহারা আর আক্রমণাত্মক বাঙালির চেহারার মধ্যে যে কতটা পার্থক্য তা আমরা এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছি। সাভারের ঘটনা এখনও রয়েছে আবেগের ঘোরে। সেখানকার মানুষের কান্না আমাদের মন, হৃদয় স্পর্শ করে আছে। শাহিনার মৃত্যুতে মনে হয়েছে আমরাও বুঝি আলিঙ্গন করলাম মৃত্যুকে। আবার রেশমার ফিরে পাওয়া জীবনের সঙ্গে আমরাও যেন নতুন করে বেঁচে উঠলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম জীবনের আনন্দে। এটাই তো বাঙালি। আবার রাতের অন্ধকারে হেফাজতে ইসলামের ওপর প্রশাসনিক অ্যাকশন মনটা কিছুটা হলেও বিষিয়ে দিচ্ছে। দেশে ফিরে ফেসবুকের কল্যাণে ওই রাতের অ্যাকশনের বেশ কিছু দৃশ্য দেখলাম। দেখে আতঙ্কিত বোধ করলাম। কিভাবে চোখের সামনে মানুষ ছটফট করে মারা যাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। অথচ অ্যাকশন কর্মীরা নির্বিকার। তাদের বডি লাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়েছে, এ ধরনের মৃত্যু যেন তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। প্রশাসনের কর্মীদেরও রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। তারাও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন। জীবন হারিয়েছেন। সেসব দৃশ্য আমরা দেখেছি। যারা মারছেন তারা বাঙালি। ভিন গ্রহের কোন মানুষও নন। আবার যারা কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন তারাও বাঙালি। এ চিত্রের সঙ্গে আপনি যদি সাভারের চিত্র মেলান তাহলে কি কোন ধরনের মিল খুঁজে পাবেন? হলফ করে বলতে পারি, পাবেন না। সাভারে বাঙালির মানবতার জয়জয়কার। সেখানে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে অন্যের মৃত্যুকে জয় করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। আর রাজনৈতিক মাঠে সে মানবিকতা কোথায়? এ দুই ঘটনার আলোকে যদি বাইরের কোন দেশের নাগরিক প্রশ্ন করে বাঙালি হিসেবে আপনারা আসলে কেমন? কি উত্তর হতে পারে? আমার জানা নেই। লজ্জিত হয় এ ধরনের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো প্রশ্নে। মাথা হেঁট হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা কেন? এক কথায় উত্তর, রাজনৈতিক দৈন্যতা। নেতৃত্বের অসহনশীলতা। অসহিষ্ণুতা। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে রাজনৈতিক নেতাদের চেহারা, তাদের বক্তব্য একেবারে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক। মনে হয় এদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আবার তারাই যখন রাজনৈতিক ময়দান কিংবা সংসদে নিজের মতামত দেন, তখন টকশোর বয়ানের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই না। বিভ্রান্তি হয়। ভাবি, এটাই মনে হয় রাজনীতির ক্যারিশমা। এ ক্যারিশমা নিশ্চিতভাবে অসুস্থ। কিন্তু আর কতদিন আমাদের এ অসুস্থ ক্যারিশমা দেখতে হবে? সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়। সবকিছুরই শেষ রয়েছে। এ ক্যারিশমাও একদিন শেষ হবে। দুই রাজনৈতিক দলের চর্চা নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সেই সঙ্গে নষ্ট করছে আস্থা ও বিশ্বাস। দেশের চারপাশে আজ মনে হচ্ছে যুদ্ধাবস্থা। সরকারি দল অনড়, বিরোধী দল আরও কঠিন। হরতালের মতো অজনপ্রিয় কর্মসূচি দিয়ে নাভিশ্বাস তৈরি করা হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায়। ভেঙে পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রম। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সংকট। সংকুচিত হচ্ছে মিডিয়ার স্বাধীনতা। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বহুল আলোচিত উক্তি ছিল ট্রেনটি লাইনচ্যুত। এখন কি আবারও ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে? কে তাকে টেনে তুলবে লাইনে? কে দায়িত্ব নেবে চালকের? আর কেইবা লাইন ক্লিয়ারেন্সের ভূমিকা পালন করবেন? কে জ্বালাবেন সবুজ বাতি? সবকিছুই কেবল প্রশ্ন। আপাতত নেই কোন উত্তর। বিদেশিরা চেষ্টা করছেন। বৈঠকের পর বৈঠক করছেন বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে। কিন্তু এসব কি আমাদের জন্য পরনির্ভরশীলতা নয়? আমরা নিজেরা কি পারি না দেশকে এগিয়ে নেয়ার কৌশল নির্ধারণ করতে? একমত হতে? দেশের প্রশ্নে তৃতীয়পক্ষের ভূমিকা কেন প্রয়োজন? তাহলে কি সত্যিই দৈন্যতা তৈরি হয়েছে আমাদের নেতৃত্বে? আর এসব প্রশ্ন আরও সম্মিলিত প্রশ্নের জন্ম দেয়। তাহলে কোথায় যাচ্ছে দেশ, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
সৌজন্য: মানবজমিন
Leave a Reply