শীর্ষবিন্দু নিউজ ডেস্ক: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তাঁর বিরুদ্ধে আনা ১৬টির মধ্যে ১৪টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। গতকাল সোমবার রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য হয়।
কায়সারের বিরুদ্ধে আনা ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৭ নম্বর অভিযোগে সাত বছর এবং ১১ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি। খালাস পেয়েছেন ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ থেকে।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আজ সকালে কায়সারকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন হয়। তাঁকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। পরে সেখান থেকে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। বেলা ১১টার পর সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। দুপুর ১২টা ১০ মিনিট থেকে শুরু করে সোয়া ১২টার মধ্যে ঘোষণা করা হয় দণ্ড।
গত ২০ আগস্ট এ মামলার কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনাল রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। সেদিন শারীরিক কারণে জামিনে থাকা কায়সারের (৭৩) জামিন বাতিল করে তাঁকে কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল। গত ২ ফেব্রুয়ারি কায়সারের বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। অভিযোগ গঠনের আদেশ অনুসারে, কায়সার ১৯৬২ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি কায়সার বাহিনী গঠন করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নৃশংসতায় অংশ নেন।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালে তিনি যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরার পর তিনি প্রথমে বিএনপি এবং পরে এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ হন এবং এরশাদ সরকারের কৃষি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
২০১৩ সালের ২১ মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কায়সারকে গ্রেপ্তারের পর ট্রাইব্যুনাল তাঁকে কারাগারে পাঠান। তবে শারীরিক কারণে জামিনের আবেদন জানালে ৫ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল তাঁকে জামিন দেন। এর পর থেকে মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার দিন পর্যন্ত তিনি জামিনে ছিলেন।
অভিযোগ: অভিযোগ গঠনের আদেশ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধকালে কায়সারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ একটি। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের অভিযোগ ১৩টি এবং ধর্ষণের অভিযোগ দুটি। ৯ মার্চ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত কায়সারের বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। রাষ্ট্রপক্ষে ৩২ জন সাক্ষ্য দেন। তাঁদের মধ্যে এক যুদ্ধশিশু প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ট্রায়ালে (সাক্ষীর পরিচয় গোপন করে রুদ্ধদ্বার বিচার) সাক্ষ্য দেন।
কায়সারের বিরুদ্ধে গণহত্যার (১৬তম) অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর কায়সারের নেতৃত্বে কায়সার বাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা যৌথভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দেউড়া, নিশ্চিন্তপুরসহ ২২টি গ্রামে হামলা চালায়। ওই হামলায় কায়সার ও তাঁর সহযোগীরা ১০৮ জন নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করে।
৮ ও ১২ নম্বর অভিযোগে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ মে কায়সার একদল পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চানপুর চা-বাগানে যান। একপর্যায়ে চা-বাগানের এক সাঁওতাল নারী শ্রমিকের ঘর দেখিয়ে দিলে দু-তিনজন পাকিস্তানি সেনা ওই নারীকে ধর্ষণ করে।
১২তম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কায়সারের নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর সদস্য ও কয়েকজন রাজাকার মাধবপুর থানার জগদীশপুর পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে এক নারী, তাঁর বাবা ও এক চাচাকে ধরে নিয়ে যায়। ওই নারীকে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে হস্তান্তর করা হলে তাঁকে ৮-১০ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। বাকি ১৩টি অভিযোগে কায়সারের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ রয়েছে।