শীর্ষবিন্দু নিউজ ডেস্ক: পাইপে পড়ার দুই ঘন্টার মধ্যেই শিশু জিহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুজ্জামান। আজ সকালে জিহাদের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, মাথায় আঘাত ও পরে পানিতে ডুবে শিশু জিহাদের মৃত্যু হয়। মাথার আঘাতেই মৃত্যু ঘটত জিহাদের। কিন্তু পানিতে ডুবে যাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যেই সে মারা যায়। এসময় সাংবাদিকরা জিহাদের জুস খাওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। চিকিৎসকদের ৩ সদস্যের একটি দল ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। বর্তমানে জিহাদের পরিবার লাশ নিয়ে শরীয়তপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে শাহাজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনীতে খেলার সময় পরিত্যক্ত গভীর পাইপে পড়ে যায় ৪বছরের শিশু জিহাদ। এরপর ২৩ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে তাকে উদ্ধারে ব্যর্থ হয় ফায়ার সার্ভিস। পরে স্থানীয়রা নিজেদের চেষ্টায় জিহাদকে উদ্ধার করে।
শিশু জিহাদ তখনো উদ্ধার হয়নি। বাইরে তাকে উদ্ধারে নানা তৎপরতা। ছেলেকে উদ্ধারের জন্য মধ্যরাতে হন্যে হয়ে সবার কাছে ছুটছেন বাবা। ঠিক এমন সময় পুলিশ তুলে নিয়ে গেল জিহাদের বাবা নাসির ফকিরকে। শিশুটি উদ্ধারের আগ পর্যন্ত শাহজাহানপুর থানায় সাড়ে ১২ ঘণ্টা আটকে রাখা হয় বাবাকে। এমনকি কোথায় জিহাদকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে জানাতে তাকে উল্টো ভয়ভীতিও দেখানো হয়। এ সময় কোনো ধরনের খাবারও দেওয়া হয়নি।
গতকাল সন্ধ্যায় শাহজাহানপুর রেল কলোনির এক আত্মীয়ের বাসায় শিশু জিহাদের বাবা বিলাপ করে এমন অসহায়ত্ব ও কষ্টের অনুভূতি তুলে ধরেন। gগত শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বাসার অদূরে রেলওয়ে মাঠের পাম্পের পাইপে পড়ে যায় জিহাদ। প্রায় ২৩ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার বেলা তিনটার দিকে জিহাদকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে শুক্রবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠ থেকে তুলে নিয়ে নাসির ফকিরকে গতকাল বেলা তিনটায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাসির ফকির ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, পাইপের ভেতর আটকে থাকা জিহাদকে উদ্ধারের জন্য তিনি যখন সবার কাছে পাগলের মতো ছুটছেন, ঠিক তখনই দুই পুলিশ সদস্য তাঁকে ধরে শাহজাহানপুর কলোনির একটি বাসায় নিয়ে কিছুক্ষণ আটকে রাখেন। এরপর সেখান থেকে একজন পুলিশ এসে মাঠের কোনায় নিয়ে যান ওসি স্যার ডাকছেন বলে। সেখানে গেলে তাঁকে পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হয়। তিনি গাড়িতে উঠতে না চাইলে দুই পুলিশ সদস্য তাঁকে জোর করে গাড়িতে তোলেন। তাঁকে বলা হয়, থানায় জবানবন্দি নেওয়ার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন তিনি বলেন, আমি থানায় যাব না, বাচ্চা তোলা হচ্ছে সেখানে থাকব। এ সময় পুলিশ সদস্য বলেন, তোমার তা দেখা লাগবে না। এরপর তাঁকে নিয়ে থানার দিকে রওনা দেন। থানায় নিয়ে তাঁকে ডিউটি অফিসারের রুমে রাতভর বসিয়ে রাখা হয়।
নাসির ফকির বলেন, পরদিন (শনিবার) সকাল নয়টার দিকে একজন দারোগা এসে তাঁকে বলেন, ‘জিহাদ পাইপের মধ্যে নেই, বাচ্চা কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, বলো।’ কোনো শত্রু আছে কি না তা-ও জানতে চাওয়া হয়। তখন তিনি বলেন, তাঁর বাচ্চা পাইপে পড়েছে, ওর খেলার সঙ্গীরা তা দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই পুলিশ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। দারোগা তখন ভয় দেখান সত্য কথা না বললে র্যাবের কাছে চালান করে দেওয়া হবে। সেখানে কিন্তু তাঁকে সত্য কথা বলতে হবে।
নাসির ফকির বলেন, দুপুরের দিকে তিনি পুলিশকে ছেড়ে দিতে আবারও আকুতি জানান। তখন তাঁকে বলা হয়, কমিশনার কথা বলবেন। এর পর থেকে আসামির মতো জেরা করতে করতে বেলা তিনটা বেজে যায়। দীর্ঘ এই সময়ে তাঁকে খাবারও দেওয়া হয়নি। তিনটার পর পুলিশ তাঁকে জানায়, তোমার ছেলে উদ্ধার হয়েছে। এরপর তিনি দৌড়ে রেল কলোনির মাঠে যান। পরে পুলিশের গাড়িতে নিথর অবস্থায় হাসপাতালে গেলে ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন। সেখান থেকে পুলিশ আবার তাঁকে গাড়িতে করে কিছুদূর গিয়ে নামিয়ে দেয়। এরপর তিনি ও তাঁর স্ত্রীর ভাই মঞ্জুর রেল কলোনির বাসায় যান।
জিহাদের মামা মো. মঞ্জু বলেন, রাত আড়াইটার দিকে জিহাদের বাবাকে তিনি খুঁজে পাননি। এরপর ফোন দিলে তিনি বলেন, আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাইতাছে। তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে আকুতি জানালেও তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তবে জিহাদের মা খাদিজা বেগম অভিযোগ করেন, থানায় আটকে রেখে তাঁর স্বামীকে মারধর করেছে পুলিশ।
জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, নাসির ফকিরকে মারধর করা হয়নি। দুটি কারণে জিহাদের বাবাকে থানায় নেওয়া হয়। এর একটি তাঁর নিরাপত্তা ও তিনি অসুস্থ। অন্যটি হলো জিহাদের বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে তথ্য পেতে। নাসির ফকিরকে আটকে রেখে পুলিশের ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়ে জানতে রাতে যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আরও দু-একজনের কাছে তিনি এমন শুনেছেন। এমন হওয়া হওয়া উচিত ছিল না। এ নিয়ে তিনি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। আরও কথা বলে বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার হবেন।