নিউজ ডেস্ক: ডেট লাইন ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়। দিনটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। ওই দিন থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হবে তা জানার জন্য উদগ্রীব মানুষ।
সরকারবিরোধী জোটের পক্ষে ওই দিন থেকে আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অপর দিকে সরকার থেকে আন্দোলন কর্মসূচি দমনের সরাসরি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এদিকে বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন দমনে সরকার গ্রেপ্তার, রিমান্ডের মতো কৌশল বেছে নিয়েছে। আন্দোলন সংগঠিত করে এগিয়ে নিতে পারে এ ধরনের নেতাদের গ্রেপ্তারের টার্গেট করেছে সরকার। ফলে কৌশল পাল্টে বিএনপিও নেতাকর্মীদের গোপনে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। তারাও গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন।
আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের দুর্বল করতে না পারে সেজন্য তাদের চাঙ্গা রাখতে নানাভাবে প্রকত তথ্য পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরপাকড়ের মহড়া শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার আন্দোলন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাসায় রাতে হানা দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গ্রেপ্তারের পর সিনিয়র নেতাদের রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। সরকারের এমন কৌশলে কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে বিএনপি। এছাড়া কোনো কোনো এলাকায় বিএনপি, জামায়াত ও তাদের শরিক দলের নেতাকর্মীরা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য।
এদিকে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল হাসান মাহমুদ খন্দকার সাংবাদিকদের বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে অপরাধ সংঘটিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, রাজধানীতে কয়েক দিন ধরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আগের তুলনায় সক্রিয়। ঢাকার প্রবেশপথ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে এখন দিনের বেলাতেও পুলিশ চেকপোস্ট বসছে।
বিশেষ করে যেসব এলাকায় বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের আনাগোনা রয়েছে সেসব এলাকায় পুলিশ ও গোয়েন্দা উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। এসব চেকপোস্টে সাধারণ পথচারীরাও তল্লাশি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ মিলেছে। রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা মামুন জানান, কাকরাইল স্কাউট ভবনের সামনে প্রতিদিন তল্লাশির শিকার হতে হয়। অনেক সময় পুলিশ মোবাইল নম্বর জানতে চায়। মোবাইল নম্বর না দিলে আটকের হুমকি দেয়।
মামুন বলেন, তল্লাশি করবে ভালো কথা; কিন্তু পুলিশকে মোবাইল নম্বর দিতে হবে কেন?’ মঙ্গলবার বিকেলেও ওই স্পটে দেখা যায় পুলিশ পথচারীদের থামিয়ে তল্লাশি করছে। রোববার রাতে কাজে যাওয়ার সময় রাহাত হোসেন (১৯) নামের এক শ্রমিককে আটক করে কদমতলী থানা পুলিশ। এ সময় আটক করা হয় আরো ৫/৬ জনকে। পরের দিন সোমবার তাদের ডিএমটি আইনে কোর্টে চালান করা হয়।
ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের ছাড়িয়ে আনতে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এভাবে রাজধানীর অনেক এলাকাতেই পুলিশ তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় পুলিশ নিরপরাধ পথচারীদের আটক করে অর্থবাণিজ্যেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও নগরীর বস্তি, আবাসিক এলাকা, বিভিন্ন মেস, আবাসিক হোটেল এবং বিভিন্ন টার্মিনালে পুলিশের অভিযান শুরু হয়েছে। মগবাজার বস্তির এক বাসিন্দা জানান, প্রায় প্রতি রাতেই পুলিশ বস্তিতে আসছে। পুলিশ বস্তির বিভিন্ন ঘরে তল্লাশি করছে। গুলিস্তানের এক আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “১ জানুয়ারি থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত হোটেলে কোনো বোর্ডার না রাখার মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ।”
রাজধানীর বাইরে সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নওগাঁ, মুন্সীগঞ্জ, পাবনা, যশোর, ঝিনাইদহ, সাতীরা, লক্ষ্মীপুর, নীলফামারী, নেত্রকোনা, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী ময়মনসিংহ, পিরোজপুর, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়ে গেছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থেকে ৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষও রয়েছে। ফটিকছড়িতে ১৫ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই সম্পৃক্ত নন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। ওই দিনই রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ থেকে ২৪ মুসল্লিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এছাড়াও গত শনিবার থেকে রোববার পর্যন্ত দেশের বিভিন্নস্থান থেকে বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ৯৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহে শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই রাতে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান রিপনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
রোববার দুপুরে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ফরাজিকে নাশকতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর জাকির হোসেনকে মির্জাগঞ্জ উপজেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করা হয়।
আমাদের লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, গত শনিবার রাতে লক্ষ্মীপুর সদর রায়পুর, কমলনগর, রামগতি, রামগঞ্জ এবং চন্দ্রগঞ্জ থানাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে গত ২৭ নভেম্বর থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত এ বিশেষ অভিযানে এক হাজার ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যশোর প্রতিনিধ জানান, গতকাল রোববার বিকেলে যশোর সদর উপজেলার রুপদিয়া বাজার থেকে বিএনপি নেতা ও নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওলিয়ার রহমানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে বিএনপির গত সোমবারের সারাদিনের হরতাল চিত্র তুলে ধরতেই নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আলমগীর দাবি করেন, হরতালের আগের দিন রোববার এবং সোমবার সারাদেশে ৪৪২ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৩ জনকে সাজা দেয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দিকনির্দেশনা ঠিক করছেন। ওই দিনকে ঘিরে কী হতে পারে তা জানতে ইতোমধ্যে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়েছে।”
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সাংবাদিকদের বলেছেন, “কোনো কর্মসূচিকে ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকতে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা আমাদের দায়িত্ব। কোনো কর্মসূচিকে ঘিরে জনজীবন আতঙ্ক হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
তিনি বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি যেভাবে হওয়ার, সেভাবেই হওয়া উচিত। কিন্তু কর্মসূচি ঘিরে অপরাধ সংঘটিত হলে তা রোধ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।