নিউজ ডেস্ক: একটি পারিবারিক ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক! সংস্থাটির কর্মীরা এখন তেমনটাই মনে করছেন। বাংলানিউজে ব্র্যাকের ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর তাতে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশের পর এবার বেরিয়ে আসছে ভেতরকার আরও তথ্য।
অনেকেই কথা বলছেন। তবে সেই একই ভয়, নাম প্রকাশ করা যাবে না, এতে তাদের ক্ষতিই বাড়বে। বাংলানিউজের অনুসন্ধান ও কর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্র্যাকের পরিবারতন্ত্র, আর একে নিজস্ব ব্যবসার মতো পরিচালনা করার সকল তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
একজন উচ্চ পর্যায়ে দায়িত্বরত ব্র্যাক কর্মী বাংলানিউজকে বলেন, চাকরি থেকে ছাঁটাই হতেই পারে, গোটা বিশ্বেই ছাঁটাই হয়। যে কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মতো করেই এই কাঁচি চালায়। কিন্তু ব্র্যাককে ভুলে গেলে চলবে না যে এটি কোনও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। সোসাইটি অ্যাক্টের আওতায় একটি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবেই এর জন্ম। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই সংস্থার ললাটে বিশ্ব ৠাকিংয়ে এক নম্বর এনজিওর তকমা লেগেছে। অন্যদের উন্নয়ন ও মানবাধিকারের তত্ত্ব শেখায় ব্র্যাক।
ব্র্যাকের সিদ্ধান্তে-কাজে মানবাধিকারের মৌলিক নীতি আর মূল্যবোধগুলোর প্রতিফলন থাকবে সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তগুলোয় থাকছে সস্তা স্বৈরাচারি, প্রতিহিংসার প্রকাশ। আর সবকিছুই চলছে পরিবারতন্ত্রে। পারিবারিক কিছু সদস্যের স্বেচ্ছাচারের প্রকাশ থাকছে এর সব সিদ্ধান্তে, মত এই কর্মীর।
সম্প্রতি যে ভাবে দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি করে আসা কর্মীদের ছাঁটাই করা হলো তা কেবলই যে অমানবিক হয়েছে তাই নয়, একটি উন্নয়ন সংস্থার এই আচরণ গোটা উন্নয়ন বিশ্বের জন্যই লজ্জার। পুরো কাজটিই হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন, অপেশাদারি পদ্ধতিতে, বলেন একাধিক কর্মী।
তারা মনে করেন, যারা এ জন্য দায়ী তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা ব্র্যাক বোর্ডের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তারা এও জানেন, বড় ট্রাজিডিই হচ্ছে এদের কিছুই হবে না, কারণ ব্র্যাকের গভর্নিং বডির সদস্যরা এখন গুটি কয় শো-পিস ছাড়া আর কিছুই নন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বোর্ড সদস্যরা প্রায় সকলেই স্যার ফজলে হাসান আবেদের দীর্ঘ সময়ের পারিবারিক বন্ধু। হার্ভার্ডের অধ্যাপক মার্থা চেন, ট্রান্সকমের লতিফুর রহমান, তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রোকেয়া আফজাল কবির, সাজেদা ফাউন্ডেশনের হুমায়ুন কবির, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের লুবনা নাহিদ চৌধুরী এরা সবাই ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ।
মার্থা চেনকে মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন একজন হিসেবেই সবাই জানে। কিন্তু তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ব্র্যাকের কর্মী হিসেবেই ছিলেন। জামালপুর ইন্টিগ্রেটেড প্রকল্পে কাজ করতেন। তিনি ও তার স্বামী লিঙ্কন চেন আবেদের পরিবারের আস্থাশীল বন্ধু। আর এ কারণে কর্মীরা মনে করেন এই চেন দম্পতি এমন কিছু কখনোই করবেন না যা আবেদ পরিবারকে আঘাত করে।
বোর্ড সদস্যদের কয়েকজন আবার ব্র্যাকের উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কারো কারো আত্মীয়-স্বজন। যেমন এরাম মরিয়াম ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ছিলেন, এখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট’র পরিচালক। তিনি রোকেয়া আফজাল কবিরের মেয়ে এবং হুমায়ুন কবিরের ছেলে বউ। এরাম মরিয়ামের বেতন যাচ্ছে ব্র্যাক থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নয়। এই সুবাদে ব্র্যাক ম্যানেজমেন্টে এরামের একটা জোর প্রভাব সবসময়ই চোখে পড়ে।
ব্র্যাক ব্যাংকের ডিএমডি ইশতিয়াক মহিউদ্দিন হুমায়ুন কবিরের ভাগ্নে। ১৯৯৩ সালে ইশতিয়াক ব্র্যাকে কাজ শুরু করেন যখন তার মা কানিজ ফাতেমা ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক পদে ছিলেন। এই কানিজ ফাতেমা এনামুল কবিরের আপন বোন। সুতরাং গভর্নিং বডি আর ব্র্যাক ম্যানেজমেন্ট আত্মীয়করণের এক জ্বলজ্বলে উদাহরণ। বলা যায় ব্র্যাক চলছেই কতিপয় আত্মীয়-স্বজনের হাতে।
ব্র্যাক যে পুরোই পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার প্রমাণ মেলে এর মূল অর্গানোগ্রামে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর চেয়ারপার্সন। তার স্ত্রী সারওয়াত আবেদ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পরিচালক, ছেলে শামেরান আবেদ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির পরিচালক, মেয়ে তামারা আবেদ ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের সিনিয়র পরিচালক। একই সঙ্গে তিনি সংস্থাটির কমিউনিকেশন অ্যান্ড স্ট্রাটেজি বিভাগেরও সিনিয়র পরিচালক।
ব্র্যাকে এই তামারার বদমেজাজি বলে ব্যাপক বদনাম আছে। পরিবারতন্ত্রের এখানেই শেষ নয়। ফজলে হাসান আবেদের জামাতা আসিফ সালেহও কমিউনিকেশন অ্যান্ড স্ট্রাটেজি বিভাগের সিনিয়র পরিচালক।
ব্র্যাকে আসিফ সালেহ এরই মধ্যে ‘তৈলবাজ’ হিসেবে নাম কুঁড়িয়েছেন। স্যার আবেদের ভাগ্নি সৈয়দা তাহিয়া হোসেন মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক। ‘খালি কলস বাজে বেশি’ এই তার তকমা।
স্যার আবেদের শ্যালিকা রেহানা আমিন মুর্শিদ ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল’র প্রোগ্রাম বিভাগের প্রধান। পেছনে সবাই ‘অকর্মন্য’ বলেই ডাকে। পরিবারতন্ত্র যে তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত তা নিশ্চিত হয়েছে নাতনি জারা যাবিনকে ব্র্যাক ব্যাংকের কাস্টমার্স এক্সপেরিয়েন্স বিভাগের প্রধান পদে বসানোর পর। এভাবেই অতি সৃষ্টিশীল পদ্ধতিতে পারিবারিক পাখা বিস্তার করা হয়েছে ব্র্যাকে। ফজলে হাসান আবেদ একটা কাজ নিশ্চিত করছেন, যাতে তার অবর্তমানে ব্র্যাক কোনও ভাবেই তার পরিবারের হাতছাড়া হয়ে না যায়।
ব্র্যাকের সকল কর্মীকে সমানভাবে দেখেন বলে যে কথাটি তিনি সবসময় বলে আসছেন, এসব আচরণের ও সিদ্ধান্তের কারণে ব্র্যাক কর্মীরা এখন তা মানছেন না। আর বৃদ্ধবয়সে পরিবারের সদস্যদের দাপটে স্যার ফজলে হাসান আবেদ নিজেই কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন বলেই মনে করছেন এর অনেক কর্মী।