নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কী একটি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা জানা গেল, তা এ রকম যে অভিন্ন মুদ্রা গ্রহণ ও ব্যবহারের উপযোগী পর্যায়ে এখন এই অঞ্চলের আটটি দেশ উপনীত হয়নি। বলতে গেলে, সে রকম প্রস্তুতিই নেই দেশগুলোর।
আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবর্তিত ইউরোর মতো দক্ষিণ এশিয়ার অভিন্ন মুদ্রা প্রবর্তন করতে গেলে আঞ্চলিক সম্পৃক্ততার যে ধাপগুলো পেরোতে হবে, সেখানেও অনেক পিছিয়ে আছে এই দেশগুলো। দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (সাফটা) চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এরপরের ধাপগুলো হলো শুল্কসংঘ, অভিন্ন বাজার ও অর্থনৈতিক ইউনিয়ন। এই অর্থনৈতিক ইউনিয়নেই অভিন্ন মুদ্রা ও মুদ্রানীতি প্রবর্তিত হবে।
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ১৯তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক কর্ম-অধিবেশনে উপস্থাপিত এক প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আইয়ুবুর রহমান ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে দক্ষিণ এশিয়ার অভিন্ন মুদ্রাবিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জুলহাস উদ্দিন। অপর দুই যুগ্ম রচয়িতা সানাউল্লাহ তালুকদার ও তারেক আজিজ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রবন্ধে বলা হয়, ইউরো চালু করতে প্রায় ৫০ বছর সময় লেগেছে। আর অভিন্ন মুদ্রা হলো আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা পূর্ণ করার শেষ ধাপ। সে জন্য দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী প্রস্তুতি নিতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় তা অনুপস্থিত। এখনো এখানকার দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক বাণিজ্য মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ।
এতে আরও বলা হয়, কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন যে অভিন্ন মুদ্রা চালু করা না গেলেও আপাতত একটি সমান্তরাল মুদ্রা চালু করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে দেশগুলো আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পন্ন করবে এবং অভিন্ন মুদ্রার জন্য প্রস্তুতি নেবে। এর সমর্থনে এও বলা হচ্ছে যে ভুটান ইতিমধ্যেই ভারতীয় রুপিকে সমান্তরাল মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছে। কাজেই বাংলাদেশ, নেপালসহ অন্য দেশগুলো তা করতে পারে।
কিন্তু প্রবন্ধে এর বিরোধিতা করে বলা হয়, ভুটানের বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ভারতনির্ভর। দেশটির ৭৫ শতাংশ রপ্তানি ও ৭৩ শতাংশ আমদানি ভারতমুখী। আবার নেপালের ৬৭ শতাংশ রপ্তানি ও ৬৩ শতাংশ আমদানি ভারতমুখী। অথচ বাংলাদেশের রপ্তানির মাত্র ৪ শতাংশ ভারতমুখী আর ১৪ শতাংশ আমদানি ভারতনির্ভর। তার মানে বাংলাদেশের জন্য রুপি সমান্তরাল মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। তা ছাড়া রুপি এখনো বৈশ্বিকভাবে পুরোপুরি রূপান্তরযোগ্য হয়নি। আবার বিগত দুই বছরে যেভাবে রুপির দরপতন ঘটেছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বিনিময় হার যথেষ্ট স্থিতিশীল।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ভারতের বরং চেষ্টা করা উচিত তাদের মুদ্রা রুপিকে আরও উদার করা, যেন তা আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার করা যায়। সে রকম একটা জায়গায় উপনীত হলে পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য অভিন্ন মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে।
উল্লেখ্য, আঞ্চলিক অভিন্ন মুদ্রায় মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশগুলোর নিজস্ব মুদ্রানীতির সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিতে হয় এবং আঞ্চলিক মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হয়। অর্থাৎ একটি অভিন্ন মুদ্রার আওতাভুক্ত অঞ্চলের বা অর্থনৈতিক ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর স্বতন্ত্র মুদ্রানীতি ও নিজস্ব বৈদেশিক বিনিময় হার নীতি থাকতে পারে না, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকও প্রয়োজনীয়তা হারায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারবে না। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিলেট বা বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয় এখন যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অফিস হিসেবে কাজ করে, ঠিক তেমনি তখন দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা অফিস হিসেবে কাজ করবে। তাই অভিন্ন মুদ্রা অঞ্চলে সদস্য সবগুলো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও মুদ্রা বিলুপ্ত হয়ে প্রতিস্থাপিত হবে একটি দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে, যার একটি অভিন্ন মুদ্রা থাকবে। এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সদস্য সব দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও তাদের ভূমিকা হবে সীমিত। কেননা, এখানে সিদ্ধান্ত হবে ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে। আর দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশই ভারতের। সে ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের বৃহত্তম দেশ ভারতের মুদ্রা রুপিই হবে এই অভিন্ন মুদ্রা।
আলোচ্য প্রবন্ধে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিন্ন মুদ্রা প্রবর্তন তো সম্ভবই না, এমনকি সমান্তরাল মুদ্রা চালু করাও দুষ্কর। বলা দরকার যে সমান্তরাল মুদ্রায় কোনো দেশের মুদ্রানীতির স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয় না। অভিন্ন মুদ্রা প্রবর্তনের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে আরও যোগাযোগ বাড়ানো, বাণিজ্য বাধা দ্রুত অপসারণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এই প্রবন্ধে।
মুদ্রানীতির স্বাধীনতা: একই অধিবেশনে উপস্থাপিত আরেক প্রবন্ধে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, মুদ্রানীতির লক্ষ্য প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যত তেমন কোনো স্বাধীনতা নেই, স্বাধীনতা আছে মুদ্রানীতির হাতিয়ারগুলো প্রয়োগের স্বাধীনতার।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তৌফিক বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজস্বনীতিই মুদ্রানীতিকে পরিচালিত করে। কেননা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এখানে বেশি প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে সরকার প্রবৃদ্ধির হারের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি ধরেই বাজারে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে।
এ প্রসঙ্গে অধিবেশনের সভাপতি আইয়ুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক চাপে পড়ছে। যেমন: রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন অনেকগুলো ব্যাংক দেওয়া হয়েছে, যা অনুমোদন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, দেশ থেকে বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে: উন্নয়নের অর্থনীতি ও রাজনীতিবিষয়ক কর্ম-অধিবেশনে অধ্যাপক আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের নিরিখে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ আজ কোথায় থাকত?’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে আজকে বাংলাদেশের জিডিপি হতো ৪২ হাজার ১৫৮ ডলার যা কি না, মালয়েশিয়ার প্রায় তিন গুণ; বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়াত ৬ হাজার ৬১ ডলার, যা মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৩৪৫ ডলার। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৯০ ডলার।
অভিন্ন মুদ্রা প্রবর্তনের আগে শুল্কসংঘ ও অভিন্ন বাজার গঠন করতে হবে ইউরো চালু করতে প্রায় ৫০ বছর সময় লেগেছে।