নানা হিসাব-নিকাশ চলছে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিতে। চারটি বিকল্পকে সামনে রেখে এ হিসাব কষছেন নেতারা। মহাজোটে থাকা না থাকা, এককভাবে নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা কি হবে এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে দলে। তবে কোন বিষয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের দল। মাস তিনেক আগে পার্টির প্রেসিডিয়াম সভায় বলা হয়েছিল- মহাজোট ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আরও একটি প্রেসিডসভা পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। এমন বাস্তবতায় মঙ্গলবার ডাকা হয়েছে কাঙিক্ষত সে প্রেসিডিয়ামের সভা। এ সভায় এরশাদ কি সিদ্ধান্ত নেন তার অপেক্ষায় আছেন দলটির নেতারা। ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা দু’ধারায় ভাগ হয়ে এরশাদকে যে যার অবস্থানে থেকে পরামর্শ দিচ্ছেন। দলের একটি বড় অংশ এখন ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে জোট করার পক্ষে। আবার অন্য অংশটি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে হয় এককভাবে বা ধর্মীয় দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করার পক্ষে।
জাতীয় পার্টিতে বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা জানিয়েছেন- শেষ পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটেই যাবে জাতীয় পার্টি। পার্টির একজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্যের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। বলা হয়েছে, বিএনপিকে বাইরে রেখে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে না। ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের নেতা হওয়ার ইচ্ছা এরশাদের নেই। জেলে যাওয়ার ভয়েই কেবল এরশাদ মহাজোট ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে দেরি করছেন। তবে যে কোন সময় মহাজোট ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। জাতীয় পার্টির একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে- এরশাদের নির্দেশে প্রায় দেড় বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ। সমপ্রতি তার মাধ্যমে জাতীয় পার্টির চাওয়ার কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংসদে ৬০-৭০টি আসন, আনুপাতিক হারে মন্ত্রীত্ব এবং এরশাদকে প্রেসিডেন্ট করা। এ দাবির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনও স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, পার্টির ৪৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩৮ জনই চাইছেন ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে জোট করতে। ২৭ জন এমপির মধ্যে ১৭ জনই একমত বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে। ১৮ দলীয় জোটে যেতে বড় ভূমিকা পালন করছেন কাজী জাফর আহমদ। তার সঙ্গে রয়েছেন এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশিদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, এস এম এম আলম, ফকির আশরাফ, মোস্তফা জামাল হায়দার, জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল, গোলাম হাবীব দুলাল, গোলাম মসিহ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, এম এ হান্নান, এস এম আবদুল মান্নান, গোলাম কিবরিয়া টিপু, সালমা ইসলাম প্রমুখ। এদের দাবি- এরশাদ যদি মাহজোট থেকে বেরিয়ে না আসেন অথবা ১৮ দলীয় জোটকে বাইরে রেখে নির্বাচনে যান তাহলে পার্টিতে ভাঙন অনিবার্য। এদিকে মহাজোটে থাকার পক্ষে যেসব প্রেসিডিয়াম সদস্য অবস্থান নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, আহসান হাবীব লিঙ্কন, মুজিবুল হক চুন্নু, নাসিম ওসমান ও সুনীল শুভরায়। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিএম কাদের বরাবরই আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত। গত নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিকে মহাজোটে নিয়ে যেতে তাদের অবদান ছিল বেশি। এ দু’জনও এখন মহাজোটে থাকতে চাইছেন না। সরকারের মন্ত্রী হয়েও জি এম কাদের পার্টির নেতা-কর্মীদের কাছে সরকারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরে সরকারে প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছেন। সমপ্রতি রংপুরে এক প্রকাশ্য জনসভায়ও তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। এরপর একাধারে দু’টি কেবিনেট সভায় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগে দু’দফায় তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। পদত্যাগপত্র তৈরি করার পরও এরশাদের অনীহার কারণে তিনি পদত্যাগ করেননি। এরশাদ তাকে বুঝিয়েছেন- আমি যখন গ্রিন সিগনাল দেবো তখন তুমি পদত্যাগ করবে। ওদিকে মহাজোট সরকারের শুরুতে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সরকারকে নগ্নভাবে সমর্থন দিলেও নেতাকর্মীদের পাল্স বুঝে তিনি এখন কৌশলী ভূমিকায়। প্রকাশ্যে তিনি সরকারের পক্ষে কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্যে তিনি প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনাও করেননি। উপরন্তু ২০০ কোটি টাকার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ রিনিউ করার প্রত্যাশায় সমপ্রতি তিনি হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শাহ শফীর কাছে সরকারের পক্ষে দূতিয়ালি করতে গিয়েছেন বলে জাতীয় পার্টির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান। তবে ব্যারিস্টার আনিস জানিয়েছেন- কারও পক্ষে দূতিয়ালি বা সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য নয়, এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
১৮ দলীয় জোটে যোগ দিতে আগ্রহী বেশ কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, তৃণমূলের ৯০ ভাগ নেতা-কর্মীই মহাজোট ছাড়তে চান। এরশাদ নিজেও চান নেতাকর্মীদের দেখানো পথে হাঁটতে। পাশাপাশি বিকল্প চিন্তাও করছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে বনিবনা না হলে ২ জোটের বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে আলাদা জোট করার পরিকল্পনাও এরশাদের আছে। এ ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে তাদের ভোটগুলো পেতে চান এরশাদ। এ জন্য সমপ্রতিক সময়ের হেফাজত ঘোষিত সব কর্মসূচিকে প্রকাশ্য সমর্থন দিচ্ছেন তিনি। দু’দফায় ঢাকায় আসা হেফাজত কর্মীদের পানি ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে পার্টির পক্ষ থেকে। এরশাদ নিজেও রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে হাজির থেকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন হেফাজত কর্মীদের মধ্যে। গত ৫ ও ৬ই মে-র সহিংসতার জন্য সরকার হেফাজত কর্মীদের দায়ী করলেও এরশাদ বিমারহীনভাবে হেফাজত নেতা-কর্মীদের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। বলছেন, হেফাজত কোন সন্ত্রাসী দল নয়। সহিংসতার জন্য হেফাজতের কোন কর্মী জড়িত নয়। পার্টির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এরশাদের নির্দেশে উদ্বুদ্ধ হয়ে ৫ই মে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা হেফাজতের পক্ষে অংশ নেয়। এতে পার্টির দু’জন নেতা নিহত হন। পুলিশের গুলিতে আহত হন অনেকে। আগামী নির্বাচনকে অনিশ্চিত হিসেবে উল্লেখ করে পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও পার্টি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও হয়তো জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে ওই নির্বাচন কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি তিনি বলেন, পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমি দালাল হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই না। বিরোধী দলের নেতা হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে জাতীয় পার্টি সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি ইতিমধ্যেই নিজের কৌশল ঠিক করেছে। কৌশলগত কারণেই আপাতত এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। মহাজোট ছেড়ে আসার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পার্টির সর্বোচ্চ ফোরাম থেকে স্যারের (এরশাদ) ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক ঘোষণা দেবেন বলে আশা করি। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে মহাজোটের সঙ্গে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। সামনের নির্বাচনে আমরা ১০০ আসন পেতে চাই। এ জন্য ১৬০-১৭০টি আসনকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।
সৌজন্য: মানবজমিন
Leave a Reply