১৯৮৪ সালে খালেদা জিয়া বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার পর এর আগে তাঁর সঙ্গে দলের অন্য নেতাদের এতটা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সম্পর্ক কখনোই তৈরি হয়নি। ২০০৭ সালে তিনি কারাগারে থাকতে বিএনপি প্রায় দ্বিধাবিভক্ত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রতি দলের অধিকাংশ নেতা এবং কর্মীদের আস্থা অটুট ছিল। এমনকি চারদলীয় শাসনামলে ‘তারেক রহমানের বাড়াবাড়িতে’ জ্যেষ্ঠ নেতারা অস্বস্তি বোধ করলেও দলপ্রধানের প্রতি তাঁদের আনুগত্যে ঘাটতি দেখা যায়নি, যা ঘটেছে তাঁর সাম্প্রতিক কিছু বক্তৃতা-বিবৃতিতে।
অনেকটা ডানের দিকে ঝুঁকে থাকলেও বিএনপি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী শক্তি’ হিসেবেই পরিচিত। দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থক তো বটেই, সাধারণ মানুষও চায় না এটি জামায়াতে ইসলামী কিংবা হেফাজতে ইসলামের সম্পূরক শক্তিতে পরিণত হোক। জনগণের একটি বড় অংশ বিএনপিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প ‘মধ্যপন্থী দল’ হিসেবেই দেখতে চায়। নানা চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলটি সেই ভূমিকা অনেকটা অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিল বলেই ধারণা করি। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তরুণ নেতা তারেক রহমান দলের ‘বিকল্প নেতা’ হয়ে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে গিয়ে বিএনপির মৌল চরিত্রই বিসর্জন দেন। সে সময় দলের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা তা অপছন্দ করলেও প্রকাশ্যে বলতে সাহস পাননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা দলের নীতি-কৌশল নির্ধারণে খালেদা জিয়াকে শেষ ভরসা মানলেও বিএনপি তারেক রহমানের মত ও পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বর্তমানে চেয়ারপারসনের সঙ্গে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তার মূলেও রয়েছে ‘যারাই আওয়ামী লীগবিরোধী তারাই বিএনপির বন্ধু’—তারেক রহমানের এই নীতি। খালেদা জিয়া নিজেও সন্তানস্নেহের ওপরে গিয়ে দলের স্বার্থকে দেখতে পারেননি। অন্যদিকে এক-এগারো পরবর্তী সময়ে দলের নেতাদের ভূমিকায় তিনি নিজেও অসন্তুষ্ট ছিলেন; যে কারণে প্রায় অচল খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দলের মহাসচিব করা হয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর দল একজন মহাসচিব এবং সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা বেছে নিতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির নেত্রীকে পথহারা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সে রকম পথহারা ঘটনা অনেকেই ঘটিয়েছেন। ৫ মে হেফাজতের সমাবেশ ও অবরোধকে সামনে রেখে ৪ মে শাপলা চত্বরে বিরোধী দলের সমাবেশে খালেদা জিয়া সরকারকে দাবি মানতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন ৪৮ ঘণ্টা আলটিমেটাম দেওয়ার জন্য বিএনপির নেতাকে পথহারা বলেন, তখন ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিলের ট্রাম্পকার্ডটির কথাও আমরা ভুলে যাইনি। শেখ হাসিনার ইঙ্গিতেই আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এই ট্রাম্পকার্ড দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষ্ফল আলটিমেটাম বা ট্রাম্পকার্ডের ঘটনা অহরহ ঘটেছে।
তাই খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম ব্যর্থ হওয়া বড় ঘটনা নয়। বড় ঘটনা হলো দলটির আদর্শ ও নীতিগত বিচ্যুতি। খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম কেন ব্যর্থ হলো, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো তিনি কাদের পরামর্শে ও কাদের ভরসায় এই আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। বিষয়টি কি তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করেছিলেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে বাইরে থেকে কারা তাঁকে প্ররোচনা জুগিয়েছেন, কারা পরামর্শ দিয়েছেন—সেসব জানার অধিকার দলের নেতা-কর্মীদের আছে।
সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তৃতা-বিবৃতি নিয়ে যেমন দলের বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তেমনি দলের ভেতরেও চাপা ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
মাস খানেক আগে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অফিসে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে তিনি সবার মুঠোফোন অফিস কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিতে বলেন। এতে দু-একজন মৃদু আপত্তি করলেও কাজ হয়নি। তাঁর নির্দেশ মান্য করেই তাঁদের বৈঠকে বসতে হয়। খালেদা জিয়ার অভিযোগ, বৈঠকে কী কী কথা হয়, তার বিস্তারিত গণমাধ্যমে চলে যায়। দলপ্রধানের সঙ্গে অন্যান্য নেতার সন্দেহ-অবিশ্বাস কোন পর্যায়ে চলে গেলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়।
গত বৃহস্পতিবার নিউ এজ পত্রিকায় বিএনপিকে নিয়ে একটি তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যার সারমর্ম হলো: বিএনপির কতিপয় জ্যেষ্ঠ নেতা দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদের বিশ্বাস, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে তাঁর ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই নেতারা মনে করেন, দলের বাইরের একটি অংশ, বিশেষ করে যাঁরা বাম থেকে ইসলামি জিহাদি বুদ্ধিজীবীতে রূপান্তরিত এবং যাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তাঁরা বিএনপির চেয়ারপারসনকে এ ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়াতে মদদ জুগিয়েছেন। আর সেই কাজে সহায়তা করছেন দলীয় চেয়ারপারসনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা, যাঁদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা রয়েছেন।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এও মনে করেন যে, জামায়াতের দেশব্যাপী তাণ্ডবের পর খালেদা জিয়ার বগুড়ায় গিয়ে ‘সরকার গণহত্যা অব্যাহত রাখলে সেনাবাহিনী অলস বসে থাকবে না’ মন্তব্য করাও ঠিক হয়নি। এর আগে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে লিখিত বক্তব্যে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ আনেন। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির নেত্রী ‘গণহত্যার’ কথা বলে একাত্তরের গণহত্যাকারীদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয়ত, গণহত্যা যদি হয়েই থাকে, সেটি দুই তরফেই হয়েছে। কিন্তু তিনি এ জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করলেও জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি।
দলের অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে খালেদা জিয়ার মন্তব্য ছিল অনৈতিক ও অন্যায্য। তিনি গণজাগরণ মঞ্চে অংশগ্রহণকারী সবাইকে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করেন। অথচ দলের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা ও কর্মীকে গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে দেখা গেছে। দলের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এ জন্য জামায়াত-শিবিরের অপপ্রচার ও আমার দেশ সম্পাদকের উসকানিমূলক লেখাকেই দায়ী করেছেন। তিনি এও বলেছেন, ‘আমার দেশ সম্পাদক বিএনপির পক্ষে কাজ করেননি বরং জামায়াতের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট ছিলেন (আমার দেশ-এর এই ভূমিকার কথা মনে রেখেও আমরা এর প্রকাশনা বন্ধ এবং হয়রানিমূলকভাবে সম্পাদকের গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করি)।
খালেদা জিয়া শুধু দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি সরকারের প্রতি যেভাবে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিলেন এবং পরদিন হেফাজতে ইসলামের ‘বিক্ষুব্ধ’ কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দলীয় নেতা-কর্মী এবং নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানালেন, তাতে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা কেবল বিভ্রান্ত নন, হতাশও হয়েছেন। স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের দাবি, ‘৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। আমরা যদি এ ধরনের আলটিমেটামের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতাম, তাহলে উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়েই কার্যকর কর্মসূচি নেওয়া যেত।’ তাঁদের মতে, দলীয় প্রধান দলের নেতা-কর্মীদের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানালেন, অথচ কেউ সাড়া দিলেন না, এটি তাঁর জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।
বিএনপির চেয়ারপারসনের অফিসের কর্মকর্তা এবং বহিরাগত ব্যক্তিদের সম্পর্কে ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘কোনো ইসলামি বিপ্লবের জন্য আমাদের কর্মসূচি নয়। আমরা মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল। ইসলাম ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চান যেসব জিহাদি বুদ্ধিজীবী, তাঁদের উৎসাহিত করার কোনো কারণ নেই।’ তিনি এও মনে করেন, এসব বুদ্ধিজীবী তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে বিএনপিকে ব্যবহার করছেন।
কিন্তু বিপজ্জনক দিক হলো, বিএনপির এসব নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের মনের কথাগুলো তাঁকে সরাসরি বলতে পারছেন না। কেননা, তাঁরা মনে করেন, এই মুহূর্তে দলের ভেতরে সে রকম গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। তাঁদের আশঙ্কা যে ‘বহিরাগত ব্যক্তিরা’ এবং চেয়ারপারসনের ‘কতিপয় কর্মকর্তা’ এতটাই ক্ষমতাধর যে তাঁরা পরীক্ষিত নেতাদের ক্ষতি করতে পারেন।
আর কর্মকর্তাদের এতটা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ চেয়ারপারসনই করে দিয়েছেন বলে অনেকের অভিযোগ। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা তা জানতে পারেন পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে। এমনকি গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বসার জায়গাও নেই এবং চেয়ারপারসনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে গেলেও তাঁকে কর্মকর্তাদের কক্ষে অপেক্ষা করতে হয়।
বিএনপির সংকট কেবল নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের কিংবা দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে অন্য নেতাদের দূরত্ব নয়। মূল সংকট হলো দলটির মধ্যে নীতি ও আদর্শের প্রচণ্ড টানাপোড়েন। প্রশ্ন উঠেছে, জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফাকে দলের মন্ত্র করেছিলেন, সেটাই বহাল থাকবে, না জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতের আদর্শকে ধারণ করবে? দলের একাংশ মনে করেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্লোগানে এখন আর বৃহত্তর জনগণকে আকৃষ্ট করা যাবে না। অতএব ইসলামি দলগুলোর সহায়তা নিয়েই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে। অপরাংশের ধারণা, দলটি যদি জামায়াত ও হেফাজতের কর্মসূচিই গ্রহণ করে, তাহলে বিএনপির নামটি রাখার কী প্রয়োজন, ওই দুই সংগঠনে নিজেদের একীভূত করাই শ্রেয়।
দুর্ভাগ্যজনক যে বিএনপির নেতারা গত সাড়ে চার বছরেও বিগত নির্বাচনে দলটির ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত এবং সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিজেদের আমলের সব অপকর্ম আড়াল করতে চাইছেন।
বিএনপির ভুল শোধরানোর চেষ্টা থাকলে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে জামায়াতি কর্মসূচির প্রতি ‘নৈতিক’ সমর্থন দিতে পারত না। নেতারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলে একবার জামায়াতের এবং আরেকবার হেফাজতের কাঁধে চড়ে সরকার পতনের খোয়াব দেখতেন না।
সব মিলিয়ে বিএনপির সংকটটি যে গভীর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
সৌজন্য: প্রথম আলো
Leave a Reply