লন্ডনে টেমস নদীর তীরের অভিজাত হোটেল পার্ক প্লাজার জনাকীর্ণ হলরুম। নানান রঙ্গের মানুষ হাতে স্টার্টার নিয়ে খোশ গল্পে মশগুল। ভীড় ঠেলে ক্যানাপি’র থালা নিয়ে ঘুরছে ওয়েটাররা। কিছুক্ষণ পরেই খুলে গেল সুরম্য আর সুসজ্জিত হলরুমের বিশাল দুই দরজা। আগে থেকেই অতিথিদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসে পড়লেন আগতরা। মঞ্চে আলো জ্বলে উঠতেই দেখা গেল আল জাজিরা টেলিভিশনের খ্যাতনামা উপস্থাপক হাস্যজ্জোল স্টিফেন কোল-কে। লেডিস এন্ড জেন্টেলমেন…., শুরু করলেন কোল। ব্রিটিশ ঐতিহ্যে ভারতিয় উপমহাদেশের কারি-কে জনপ্রিয় এবং আনন্দদায়ক খাবার হিসেবে উল্লেখ করে বর্ণনা দিয়ে গেলেন ব্রিটেনে কারি শিল্পের ইতিহাসের। নিজেকেও একজন কারি ভক্ত বলে উল্লেখ করলেন কোল।
গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় এভাবেই শুরু হয় নান্দনিক কারি লাইফ শেফ এওয়ার্ড ও গালা ডিনারের। তার আগে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় কারি এক্সপো। এক্সপো এবং ডিনারে সারা দেশ থেকে কয়েক শত কারি প্রেমিক, বিশেষজ্ঞ, শেফ এবং রেস্টুরেন্ট মালিক এসেছিলেন। কিচেন হিরোদের সংবর্ধনা এবং সম্মাননা জানানোর জন্য আসেন তারা।
সন্ধ্যায় এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানের শুরুতেই সারা ব্রিটেনে ‘কারি’ ইন্ডিয়ান খাবার হিসেবে পরিচিত হলেও তার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় উপস্থাপক স্টিফেন কোল বাংলাদেশিদের কারি শিল্পের পাইয়নিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেন। তার উপস্থাপনায় কারি লাইফের এই অনুষ্ঠানে কারি শিল্পে উদ্ভাবনীমূলক অবদান রাখার জন্য ব্রিটেনের মোট ২১ জন মেধাবী শেফকে পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া সুইডেন থেকে একজন শেফকে ইউরোপীয়ান ক্যাটাগরিতে এবং ভারতের একজনকে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করা হয়।
অনুষ্ঠানে শেফদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন বিজনেস মিনিস্টার ম্যাথিউ হ্যানকক এমপি, পপলার এন্ড লাইম হাউসের লেবার এমপি জিম ফিটজপ্যাট্রিক, বেথনাল গ্রিন এন্ড বো আসনের এমপি এবং শ্যাডো ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার রুশনারা আলী, এনফিলড এলাকার এমপি নিক ডি বোয়া, রিডিং এর এমপি অলোক শর্মা, ক্যামডেন এর এমপি ফ্রাংক ডবসন, অল পার্টি পার্লামেন্টারিয়ান গ্র“পের চেয়ার অ্যান মেইন এমপি, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের বিদায়ী হাইকমিশনার ড. এম সাইদুর রহমান খান প্রমুখ।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রবীণ ও তরুণ শেফরা তাদের পরিবার এবং সহকর্মীদের সাথে উল্লাস প্রকাশ করেন। এবছর ইউরোপীয়ান ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ শেফ নির্বাচিত হয়েছে সুইডেনের একজন কারি শিল্পি। আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন আলহাজ রফিক উদ্দিন। ৮২ বছর বয়সী রফিক উদ্দিন ৪০ বছর আগে সিটি অব কার্লাইলে প্রথম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই ব্যবসা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গত বছর তার ছেলে তার নামে একই শহরে ‘রফিক’স’ নামের রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনুষ্ঠানে আয়োজক সৈয়দ নাহাস পাশা অনুষ্ঠানের স্পন্সর জাগুয়ার, কোবরা বিয়ার, ইকবাল ব্রাদার্স, এলোডস, পেপসি এবং এসএমসিএলকে ধন্যবাদ জানান। এছাড়া বাংলাদেশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন, হাইকমিশনার ড. এম সাইদুর রহমান, কারি লাইফ সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমেদসহ কারি লাইফ টিম, জনমত সম্পাদক নবাব উদ্দিনসহ জনমত টিম, চ্যানেল এস টিম এবং অন্যান্য কমিউনিটি নেতৃবৃন্দদের প্রতি সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
সৈয়দ পাশা তার বক্তব্যে বর্তমানে ব্রিটিশ কারি শিল্পের বিভিন্ন সংকটের দিক তুলে ধরে উপস্থিত মন্ত্রী এমপিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি তার বক্তব্যে কারি শিল্পে বর্ধিত ভিএটি, জনবল সংকট, ইমিগ্রেশন রেইড প্রভৃতির কথা ত*লে ধরেন। পাশা তার এই কারি শেফ এওয়ার্ড সম্পর্কে বলেন, এই ক্ষে(েড) অনেকেই কাজ করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানই নানা এওয়ার্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস কারি লাইফ-ই কেবল মা(ড) এত বড় পরিসরে সমগ্র ব্রিটেনের শেফদের নিয়ে কাজ করে এওয়ার্ড দিয়ে থাকে। অন্য কোন সংগঠনই এত বিস্তৃত পরিসরে কাজ করেনি। তার সাথে একমত পোষণ করে কোবরা বিয়ারের চেয়ারম্যান লর্ড বিলিমোরিয়াও এসব বিষয়ে দৃষ্টি দিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
কারি লাইফ শেফ এওয়ার্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, আজীবন সম্মাননা প্রদান কারি ইন্ডাস্ট্রির একটি শক্তিশালি দিক তুলে ধরে। একেবারে একটি নতুন ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ক্রেতা আকৃষ্ট করা এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রমান এটি। বিলিমোরিয়া তার ১৯ বছর বয়সে ব্রিটেন আসার স“ৃতি রোমন্থন করে সেই সময়ের ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, ব্রিটেনে কারি শিল্পের বিভিন্ন এওয়ার্ডের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম এওয়ার্ড সিরিমনি কারি লাইফ শেফ এওয়ার্ড। কারি লাইফ ম্যাগাজিনের উদ্যোগে এই এওয়ার্ড অনুষ্ঠান শুরু হয়। সারা ব্রিটেনে বাংলাদেশি এবং ভারতিয় প্রায় ১০ হাজার কারি শেফ এবং তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ভ্যানগার্ড এই ম্যাগাজিন। এই ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠিত হয় ১০ বছর আগে। ২০০২ সালে ঢাকা শেরাটন হোটেলে ব্রিটিশ ফিউশন ফ*ড ফেস্টিভ্যাল করার মাধ্যমে শেফদের নিয়ে কারি লাইফ এর যা(ড)া শুরু হয়। তার পর থেকে প্রতি বছরই তা বাংলাদেশ ভারত এবং উপমহাদেশীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কারি ফেস্টিভ্যাল করে আসছে। নাহাস পাশা বলেন, আমরা ২০০৯ সাল থেকে শেফদের পুরস্কৃত করার কাজ শুরু করি। যেসব শেফরা তাদের মেধা এবং কর্মদক্ষতা দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে ব্রিটিশদের মধ্যে কারির স্বাদের প্রচলন করেছে তারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকটাই অবহেলিত। কারি লাইফ মনে করে তাদের স্বীকৃতি এই ইন্ডাস্ট্রিকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে।
এবছরে কারি লাইফ শেফ এওয়ার্ড পেলেন যারা ” স্পাইস বাজার রেস্টুরেন্টের (কানক) রুহেল আহমেদ, উষা রেস্টেুরেন্টের (বার্নলী) ইব্রাহিম আলী, মৌচাক রেস্টেুরেন্টের (পোর্টসমাউথ) কাউছার মিয়া, দ্য রাজ স্পাইসের (ওয়েস্ট মিডল্যান্ড) সাহিদুর রহমান, দ্য বেঙ্গলি ব্রাসেরির (ওয়েদারবি) মোহন মিয়া, সোয়ানসির চিলিজ তান্দুরী রেস্টুরেন্টের মো” জহিরুল ইসলাম, রাজ অব ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্টর (হার্টস) আব্দুল মালিক, তাজ কুইজিনের (চাটাম) আবুল মনসুর, রিপলে কারী গার্ডেনের (সারে) মো” সালিম উদ্দিন, চিলি লজ রেস্টুরেন্টের (টিঙ্গলে) সাদিক মিয়া, বেঙ্গল কটেজের (বল্টন) সুয়েবুর রহমান, পিংক গার্লিকের(এসেক্স) মো” সেবুল মিয়া, ভোজন রেস্টুরেন্টের (এসেক্স) ফরিদ আলী, তারানা রেস্টুরেন্টের (সারে) সুফী তালুকদার, রূপালী রেস্টুরেন্টের (কভেন্ট্রি) সুন্দর আলী, স্পাইস হাটের (এসেক্স) খলিলুর রহমান, কারি লিফ ইন্ডিয়ান টেইকওয়ের কায়ছার আহমেদ। শিখা ইন্ডিয়ান টেইকওয়ের আব্দুল কাহার। মাহিম ইন্ডিয়ান টেইকওয়ের তাজ উদ্দিন।
স্পেশাল এ্যাওয়ার্ড অব দ্য নাইট- ইউরোপিয়ান কারি শেফ অব দ্য ইয়ার- ইন্ডিয়ান গার্ডেনের (স্টকহোম, সুইডেন) রেজাউল করিম। কারি শিল্পে উদ্ভাবনিমূলক অবদানের জন্য, এইচএইচআই গ্র“প অব হোটেলস, ইন্ডিয়ার উ”পল মন্ডল। কাটলারস স্পাইস, শেফিল্ড, নঈম উল্লাহ (৭৫)। আজোবধি সাফল্যের সাথে পারিবারিক ব্যবসায় পরিচালনা করছেন এবং শেফ হিসাবে কর্মরত রয়েছেন।
লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়াডর্, কার্লাইলসের আলহাজ্ব রফিক উদ্দিন।
Leave a Reply