রাজু আহমেদ: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকাস্থ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাত্র ১৯ মিনিটের একটি বিখ্যাত ভাষণ ৭ কোটি বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহাকে চাঙ্গা করে দিয়েছিল । দুনিয়া কাঁপানো ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম এ ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ’৭১ সালের ২৬ মার্চ দেয়া হলেও মূলত ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার বীজ বপনের দিন । ’৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তানিরা ক্ষণে ক্ষণে যে স্বাধীনতার স্বপ্নের জাল বুনেছিল সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যে অবশ্যম্ভাবী সেটা স্পষ্ট হয়েছিল ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কথার গাঁথুনিতে । বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সে বক্তৃতার সূত্র ধরেই এ বঙ্গের ৭ কোটি মানুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছিনিয়ে এনেছিল আকাঙ্খিত স্বাধীনতা । বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণের গুরুত্ব স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়েই বিলীন হয়ে যায়নি বরং তাতে বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির চলার পথের দিক-নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা আজও চির অমলীন হয়ে আছে ।
৭ মার্চের ভাষণের পেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় প্রসারী । মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বিমাতা সূলভ আচরনের প্রতিবাদ এবং বাঙালির মুক্তির পথ দেখানো ছিল এ ভাষণের মূল উপজীব্য । ’৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সামরিক শাসক ইয়াহইয়া খান নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মুসলিমলীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করে । শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরই নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানিদের এধরণের অনেকগুলো অন্যায় কাজের প্রতিবাদের কঠোর প্রকাশই ফূটে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে ।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোন পরিকল্পনায় হবে, বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের কোন উপায়ে প্রতিহত করবে, প্রতিরোধের ধরণ এবং শিক্ষা কেমন হবে এবং কোন আদর্শিক মতাদর্শে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হবে তার পূর্ণাঙ্গ ছক চিত্রিত হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যে । বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও পূর্ব-পাকিস্তানের ভবিষ্যত নির্ধারন করতে কোন অংশ বাদ রাখেননি । বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শুরুতেই উপস্থিত কোটি জনসমুদ্রকে ‘প্রিয় ভাইয়েরা’ সম্বোধন করে আপন করে নেন । মাত্র ১৯ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন ।
একই সাথে মুসলিমলীগের প্রধান হিসেবে তার নিজের ভূমিকা ও অবস্থান স্পষ্ট করেন । ’৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন ও তার ফলাফল এবং পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উপর একটি নতিদীর্ঘ আলোচনা করেন । সামরিক শাসক ইয়াহইয়া খানের কাছে সামরিক আইন প্রত্যাহারসহ পূর্ব-পাকিস্তানিদের ওপর চালানো বর্বোরোচিত অত্যাচার এবং সামরিক আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানান । বঙ্গবন্ধু হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, যদি এ দাবী মেনে নেওয়া না হয় তবে সামগ্রিকভাবে অন্যায়ের মোকাবেলা করা হবে এবং দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়া হবে ।
বঙ্গবন্ধু-এই সর্বজন স্বীকৃত নামটা উচ্চারিত হলেই সবার হৃদয়ের মনি কোঠায় জেগে ওঠে বিনয়াবনত শ্রদ্ধা । যেন সবাই অন্তর চক্ষু দ্বারা অনুভব করে, তর্জনী উঁচু করে আজও বজ্র কন্ঠে ঘোষণা করছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ আজও শ্রবন করলে রক্তের অনুরণন ঘটে । যতবার শুনি ততবার নতুন করে শিহরণ অনুভূত হয় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা । দিয়েছিলেন ন্যায়ের পক্ষে জীবন বাজি রাখার প্রেরণা ।
তিনি বলেছিলেন, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব । বিশ্বের সকল বাঙালীকে তার অমোঘ ঘোষণার মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং অন্যায়কে প্রতিহত করতে হবে । বঙ্গবন্ধু তার বজ্রকেন্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন এই বলে, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে, তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করত হবে ।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জাতির জন্য শিক্ষা ছিল কিভাবে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে-হোক সে বাইরের শত্রু কিংবা ঘরের শত্রু । বাঙালিকে তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন শুধু মরনাস্ত্র দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করা যায় না । শত্রুকে পরাজিত করার জন্য চাই অনেক কলা-কৌশল । তাইতো স্বাধীনতার স্থপতি বলেছিলেন, আমরা তাদেরকে ভাতে মারবো, পানিতে মারব । বঙ্গবন্ধুর বাতলে দেয়া সে কৌশল অবলম্বন করেই স্বাধীনতা যোদ্ধারা অস্ত্রের বলে বলীয়াণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রায় খালি হাতেই জয়ী হতে পেরেছিল । ’৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে বঙ্গবন্ধুর শেখানো অনেক কৌশল প্রয়োগ করেছিল ।
তাইতো ৯ মাস দীর্ঘকালব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এদেশের মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীকে খাদ্যে কষ্ট দিয়েছে । এদেশের বিভিন্ন খাল, বিল ও নদীতে তাদেরকে চুবিয়ে চুবিয়ে মেরেছে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণের একেবারে শেষদিকে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে জাতিকে সাবধান করে বলেছিলেন, যেন বন্ধুর বেশে শত্রু আমাদের অন্দরে প্রবেশ করে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে । বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহীনি ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে ।
সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালগুদেরকে নির্যাতন এদেশের জন্য একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । অতীতে বারবার তাদেরকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়েছে । দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির খরা চলছে অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-নন বাঙালী যারা আছে-তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনার উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয় । ৪৪ বছর পূর্বে অর্জিত স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তার সে দর্শন আজও আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল পরিমন্ডলে অবশ্য পালনীয় ।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক ! মনে রাখবা ! রক্ত যখন দিয়েছি আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ ! এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ! জয় বাংলা !! ।
যে বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করেছিল, এনে দিয়েছিল অমূল্য স্বাধীনতা, সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুরু হয়েছে চরম দলীয়করণ অথচ বঙ্গবন্ধু কোন দলের, ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি নন । তিনি সবার । প্রকৃত বিচারে ৭ মার্চের ভাষণের হাত ধরেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, একটি স্বাধীন ভূখন্ড-বাংলাদেশ । আমরা বঙ্গবন্ধুকে তার যথার্থ সম্মানের স্থানে আসীন করতে পারিনি কারন এর পিছনে ষড়যন্ত্র করছে রাজনীতির জঘন্য মানসিকতা ।
সেকারনে আমরা প্রায় সময়েই বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখি অথচ বিশ্ববাসী তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতে একটুও ভুল করেনি । তার ৭ মার্চের ভাষনটি স্থান পেয়েছে দুনিয়া কাঁপানো ভাষনগুলোর শীর্ষের দিকে । এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজও পৃথীবির কোন মহান নেতা সংক্ষিপ্ত সময়ে এত তাৎপর্যমন্ডিত ভাষণ দিতে পারেন নি । রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা ইউএসবি (USB) বঙ্গবন্ধুকে `World political poet’ বা বিশ্ব রাজনীতির কবি উপাধীতে ভূষিত করেছে । সুতরাং ৭ মার্চের ভাষণের প্রেরণায় উজ্জীবিত হোক গোটা দেশ, সমগ্র বাঙালী সমাজ ।
স্বাধীনতা অর্জনের মানসে উৎসর্গিত তিরিশ লাখ শহীদের বুকের তাজা খুন এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম যেন বৃথা না যায় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মানে স্বাধীনদেশের ১৬ কোটি মানুষ যেন হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারি, এই হোক ২০১৫ সালের ৭ মার্চের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের শিক্ষা এবং আমাদের শপথ ।