ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যে বুঝা যায় দেশের সবকিছুই স্বাভাবিক, যেন কোনো সমস্যাই নেই, বিরোধী জোটের আন্দোলন-সংগ্রামেরও কোথাও কোনো প্রভাব নেই। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রথম ৫২ দিনের হরতাল-অবরোধে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছেন।
দেশের সার্বিক এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অর্থের অংকে হিসাবটা কতটা নির্ভরযোগ্য ও যৌক্তিক তা অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তবে রাজধানীর এসি রুমে বসে মন্ত্রী-এমপিদের এধরনের বক্তব্যের সাথে যে বাস্তবতার কোনো মিল নেই তা বর্তমান নাগরিক সেবা পরিস্থিতির আলোকে সহজেই বলা যায়। চলমান রাজনৈতিক সংকটে দেশের মানুষ যে কতটা অসহনীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন তা মাঠ পর্যায়ে জনগণের কাছে না গেলে বুঝার কোনো উপায় নেই।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে উত্তরাঞ্চলের বহুপুরানো শহর রাজশাহীতে গিয়ে খোঁজ করলাম মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের, জানা গেলো মেয়র তো বহু মামলার আসামী, ফলে অনেক দিন থেকেই তিনি আত্মগোপনে। মেয়রকে না পেয়ে এক কাউন্সিলরের খোঁজ করলাম, একই কথা। জানা গেল- শুধু মেয়র কিংবা দু’একজন কাউন্সিলরই নন, এভাবে বেশীর ভাগ কাউন্সিলর গত কয়েক মাস থেকে আত্মগোপনে ।এছাড়া রাজশাহী শহর সংলগ্ন কাটাখালী পৌরসভায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল মেয়র অধ্যাপক মাজেদুর রহমান দীর্ঘ দুই-আড়াই বছর আত্মগোপনে থাকার পর মাস তিনেক আগে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে জেলখানায় রয়েছেন।অধিকাংশ কাউন্সিলরও পলাতক।
এঅবস্থা শুধু রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনেই নয়, গোটা দেশের প্রায় সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বিরাজ করছে। যতদূর জানা গেছে তাতে, স্থানীয় সরকারে যেসব মেয়র-কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও মেম্বার সরকার দলীয় তাদের ছাড়া বাকীরা সবাই পলাতক না হয় জেলখানায়। অনেকে ক্রসফায়ারের ভয়ে স্বেচ্ছায় কারাবরণও করেছেন। আবার কোথাও কোথাও অভ্যন্তরীণ কিংবা প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে খোদ সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধিরাও আত্মগোপনে রয়েছেন। ইতোমধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুর রহমান জেলে, রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামাল আত্মগোপনে। রংপুরের মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় শতভাগ নিরাপদে। ক্ষমতাসীনদের সাথে আঁতাতে চট্টগ্রাম মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম মঞ্জু ও খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান মনি অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তাদের বেশীর ভাগ কাউন্সিলর আত্মগোপনে।
এছাড়া সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যশোরে স্থানীয় সরকারের ৭০ ভাগ জনপ্রতিনিধি ফেরারি জীবনযাপন করছেন। হামলা-মামলার শিকার এসব জনপ্রতিনিধির সবাই এলাকাছাড়া। তাদের অনুপস্থিতির কারণে এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অবর্তমানে শূন্যস্থান পূরণে ক্ষমতাসীন দলে শুরু হয়েছে অশুভ প্রতিযোগিতা, যা স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। বাড়ছে হানাহানি। (সূত্র: দৈনিক মানবজমিন- ১০ নভেম্বর, ২০১৪)।
এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে গত কয়েক মাস থেকে নাগরিক সেবা তো দূরের কথা জনপ্রতিনিধিদের দেখাই মিলছে না সাধারণ নাগরিকের। এতে সহজেই অনুমেয়- স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবার অবস্থা কতটা নাজুক।
আমাদের সবার পরিচিত শহর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কথাই ধরা যাক, ডিসিসি ভেঙে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নামে দুটি নতুন সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়েছে ( ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর)তিন বছর আগে। ডিএনসিসির ৩৬টি এবং ডিএসসিসির ৫৬টি ওয়ার্ড মিলিয়ে ঢাকার মোট ৯২টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এ পর্যন্ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাননি। এরফলে বছরের পর বছর মেয়র-কাউন্সিলর না থাকায় রাজধানীতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। সেবা কার্যক্রম ঠেকেছে তলানিতে। অথচ নাগরিক সেবা নগরবাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে রাজধানীতে দুটি সিটি করপোরেশন করা হলেও উল্টো জনপ্রতিনিধিশূন্য এই নগরের সেবা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভোগান্তি।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি গঠিত হওয়ায় বিলুপ্ত ডিসিসির কাউন্সিলররা ক্ষমতা হারান। ফলে নাগরিকত্বের সনদ, জন্মসনদ, ওয়ারিশ সনদসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজের দায়িত্ব আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে (আনিক) দেওয়া হয়। ৯০ কাউন্সিলর এবং ৩০ সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর থাকাকালে বাসাবাড়ির কাছাকাছিই কাউন্সিলরের কার্যালয় ছিল। তবে ডিএনসিসির ৫টি ও ডিএসসিসির ৫টি মিলিয়ে দুই কর্পোরেশনে আনিকের কার্যালয় মাত্র ১০টি। আর এ কারণে এসব সেবার জন্য নগরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে হয় নগরবাসীকে। যেমন ধরা যাক, মগবাজারের বাসিন্দাদের যে কোনো সনদের জন্য যেতে হয় গুলশান দুই নম্বরের আনিক কার্যালয়ে।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পত্রিকায় সচেতনামূলক বিজ্ঞাপন দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে দুই সিটি কর্পোরেশন। কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিনোদন কেন্দ্র, পার্ক স্থাপনের কোনো প্রকল্প নেই দুই সিটি করপোরেশনের। বন্ধ হয়ে গেছে সমাজকল্যাণ কার্যক্রমও।
ঢাকার সড়কগুলো ভেঙে বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এসব সড়ক দিয়ে চলার কোনো উপায় নেই। ভেঙে গেছে গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়কও। এসব সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বাসিন্দারা। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে নগরবাসী যেন অতিষ্ঠ। ফলে ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহরের তকমা পড়েছে। শহরের বেশিরভাগ ড্রেন ও পানি নিষ্কাশন পাইপলাইন সিটি কর্পোরেশনের হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসাই এখন প্রধান ভরসা। ডিসিসির ড্রেনেজ লাইনগুলোর বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও প্রতি বছর এই খাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। বিপরীতে নগরবাসীর পথচলা জলাবদ্ধতায় আটকে থাকছে। আগামী বর্ষা মওসুমে যে কী দশা হবে তা ভাবতেই অবাক লাগছে।
আমরা এখন যাবো কোথায়, কার কাছেই অভিযোগের কথা জানাবো। ফলে আমরা সবাই অসহায়।
এ সমস্যা তো দু-একদিনেই হয়নি। গোড়াতেই গলদ, রোগ সাড়বে কেমন করে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আইনের ত্রুটি থাকার কারণেই আজ আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত ‘স্থানীয় সরকার খাত সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তোলনের উপায়’-শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এমন তথ্যই উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইনে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের পরিষদের উপদেষ্টা করে তাদের পরামর্শ গ্রহণের যে বিধান রাখা হয়েছে, তার ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে স্থানীয় এমপি’র দ্বন্দ্ব চরমে, দুজনের নির্বাচনী এলাকা প্রায় এক; দু’জনেই নির্বাচিত। কিন্তু আইনে এমপিকে চেয়ারম্যানের ওপর খবরদারির কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কাজ করছে না।
বিদ্যমান আইনের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে প্রতিবেদনে আইন সংশোধন করে তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের সুপারিশে বলা হয়,
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের সময় নির্ধারণ ও তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত কে গ্রহণ করবে তা আইনে উল্লেখ করা হয়নি।
এছাড়া, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট নারী সদস্যদের দায়িত্ব ও কাজের আওতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান নেই। আইনের এসব অপ্রতুলতার কারণেও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের যথেচ্ছাভাবে অপসারণ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসক দেয়া হচ্ছে। এতে করে গোটা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এক ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে।
সবশেষে বলবো- কেন্দ্রীয় সরকার যতই সফলতা ও দক্ষতার সাথেই কাজ করুক না কেন, এতে স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্যই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। অথচ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এক চোখা নীতি তথা রাজনৈতিক ছোবলের ফলে ব্যবস্থাটি দৃঢ় কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগুতে পারছে না। বিরোধীদল থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নিতে পারেন না। তারা নানা মামলায় জড়িয়ে জনগণ থেকে আড়ালে থাকে। যার ফলে নির্বাচক জনগণ নাগরিক অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। উপরন্তু একাধিক ধাপের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট হওয়ায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও ইমেজ সঙ্কটে উপনীত হয়। এ কারণে আমরা মনে করি এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানদের আইনী সীমাকে কার্যকর করতে আইনের শাসনকে আরো কার্যকর করতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে জনসেবকের কোন বিকল্প নেই। আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে, কোন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যায় না।
তাই দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার উন্নয়নের স্বার্থেই বর্তমান এই অপ-রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে স্থানীয় সরকারকে বের করে গণতান্ত্রিক বিবেচনায় স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে হবে। আর এভাবেই স্থানীয় সরকারের দ্বারা স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন সাধিত হবে এবং দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক,