ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে একের পর এক ফর্মুলা দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার স্থায়ী ও টেকসই সমাধানে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও একটি রূপরেখা
প্রণয়নের কাজ চলছে। বিদেশি কূটনীতিকরা একটি ফর্মুলা দিয়েছেন সরকার ও বিরোধীপক্ষের কাছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী কয়েকটি রাষ্ট্রও সংলাপে বসতে বারবার সরকার
ও বিরোধীপক্ষকে তাগিদ দিচ্ছেন। বিএনপি সংলাপে বসতে রাজি হলেও সরকার অনীহা প্রকাশ করে আসছে। ক্ষমতাসীন মহাজোটের নেতারা বলছেন, পেট্রলবোমায় মানুষ মারার রাজনীতি বন্ধ হলে, সংলাপের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
অন্যদিকে ২০ দলের ডাকা আন্দোলনের ৫৩ দিনের মাথায় ১৩ মার্চ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেছেন, যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এছাড়া সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে তিনি বলেছেন, “ক্ষমতাসীনরা আলোচনা করতে না চাইলে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এককভাবে তাদের উপরই বর্তাবে। তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন চলছে।এই সংসদে সংবিধান সংশোধন করে সরকার পদত্যাগ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে, তখন সমস্যার সমাধান হতে পারে।”(প্রথম আলো,বিবিসি বাংলা, ১৩ মার্চ ২০১৫) ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের এই মনোভাবের মধ্যেও সংলাপে বসতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের চাপ বাড়ছেই।
এদিকে প্রবীণ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সংকট সমাধানে গণভোট আয়োজনের ফর্মুলা তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্য গণভোটে যদি জনগণ মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় তাহলে নির্বাচন দিতে হবে। আর যদি না চায় তাহলে বর্তমান সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবে।
অন্যদিকে সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন আছে কি- না তা নির্ধারণ করবে জনগণ, কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এ জন্য প্রয়োজন গণভোটের। তিনিও সংকট নিরসনে গণভোটের কথা বলেছেন।
এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াসহ ৪২টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি দেন।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সংকট নিরসনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার খোলনলচে বদলে ফেলার ফর্মুলা দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন
আহমদ সংকট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্যের একটি সরকার গঠনের প্রস্তাব
দিয়েছেন। সংকট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিবকে চিঠিও দিয়েছেন তিনি।
সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সংকট সমাধানে
গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবসহ রাষ্ট্রপতিকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী
হওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি সংকটের স্থায়ী সমাধানে একটি নির্বাচনী
ফর্মুলাও তুলে ধরেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী নতুন ফর্মুলায়
৩টি প্রস্তাব দিয়েছেন, এক. নবম সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে
রাষ্ট্রপতির অধীনে একটি জাতীয় সরকার গঠন, দুই. জাতীয় সরকারে যারা
থাকবেন তারা আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। তিন. জাতীয়
সরকারের প্রধান কাজ হবে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সব
দলের অংশগ্রহণে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
চলমান সংকটের স্থায়ী সমাধানে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড.
এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রূপরেখা
প্রণয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শিগগিরই তারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে
এ রূপরেখা তুলে ধরেবেন। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান
মান্নার দুটি অডিও টেপ গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং মান্না গ্রেফতার
হওয়ার পর নাগরিক সমাজের উদ্যোগে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে সংগঠনটির
প্রতিনিধিরা বলছেন তাদের উদ্যোগ চলমান।
নাগরিক সমাজের সদস্য ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার
জানিয়েছেন, ‘চলমান সংকটের সমাধানে নাগরিক সমাজের রূপরেখা প্রণয়নের
কাজ চলছে। শিগগিরই তা প্রকাশ করা হবে। চলমান সংকট নিরসনে
দুপক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসাতে তাদের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।’
(দৈনিক আমাদের সময়, ১৪ মার্চ, ২০১৫)
চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বিদেশি কূটনীতিকরা রাষ্ট্রপতি মো.
আবদুল হামিদের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে সক্রিয়
রয়েছেন। গত ৩ মার্চ ১৭ দেশের কূটনীতিকরা বিএনপি চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে ৩টি ফর্মুলা দেন। এক. শেখ হাসিনাকে
প্রধানমন্ত্রী রেখে সব দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের
অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান, দুই. রাষ্ট্রপতির অধীনে সব দলের সমন্বয়ে
গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের অধীন নির্বাচন, তিন.
আন্দোলনের নামে যে রাজনৈতিক সহিংসতা হচ্ছে তা বন্ধ করে সংলাপ
অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরিতে সংলাপ। বিএনপি চেয়ারপারসন প্রথম ফর্মুলার
ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও অন্য ফর্মুলা ২টির বিষয়ে ইতিবাচক
সাড়া দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের এসব ফর্মুলা
নিয়ে সক্রিয় রয়েছেন। তারা সরকার এবং বিরোধীপক্ষের সঙ্গে এ
নিয়ে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের
আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংকট সমাধানে সমঝোতায় আসতে
বিদেশি কূটনীতিকদের অনুরূপ একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবেও
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করে তার অধীনে অথবা রাষ্ট্রপতির
অধীনে সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল।
এদিকে দুপক্ষকে সমঝোতায় আনতে ঢাকার জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন,
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা দৌড়ঝাঁপ
অব্যাহত রেখেছেন। শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির।
কিন্তু এরপরও কী সংকট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে?
না, এখনো সমাধানের কোনো পথ কিংবা আশার সঞ্চার হয়নি। বরং
শুক্রবার বেগম খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলনের পর সংকটের উত্তাপ
আরো বেড়েছে বলেই লক্ষ্যণীয়। মধ্যবর্তী নির্বাচন ইস্যুতে গত দুইদিনে
দু’পক্ষের বাকযুদ্ধেই প্রতীয়মান হয় যে, সহসাই কোনো সমাধান হচ্ছে
না।
ফলে বাংলার আকাশে আজ মহাদুর্যোগের ঘনঘটা। আকাশে কালো মেঘের
ধোঁয়া, বাংলার সবুজ জমিন আজ নিরপরাধ বাঙালী বনী আদমের রক্তে
রক্তসিক্ত। দু’পক্ষই কথা বলছেন হুমকির ভাষায়। জনগণের স্বাভাবিক
জীবনযাত্রা হচ্ছে ব্যাহত। নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে ধূর্ততার অবাধ
প্রকাশ বিবেকবান ও সচেতন মানুষকে করছে ক্ষুব্ধ। এই পরিবেশকে কেউ
বলছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সাথে বিপক্ষের শক্তির লড়াই । কেউ
বলছে গণতন্ত্রকামী জনগণের সাথে স্বৈরশক্তির লড়াই। আসলে কি তাই?
স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করছেন, তারা সত্যিই
স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে এমনটি করছেন? অন্যদিকে যারা
আন্দোলন করছেন তারাও কী সত্যিকারের গণমানুষের অধিকার আদায়ে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করছেন? এসব কিছু আজ প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।
কেননা, যেখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে পেট্রোলবোমা কিংবা আইন-
শৃংখলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে প্রতিনিয়ত মানুষের জীবন ঝরছে, সেখানে
তাদের এ স্লোগানের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল দেখতে পাচ্ছি না
আমরা।
এরপরও চলমান সংকট থেকে জাতিকে বের হতেই হবে। এভাবে কিছু
রাজনীতিবিদের হাতে দেশ ও জনগণ জিম্মি থাকতে পারে না। রাজনীতিতে
শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে হয়ে আসছে। তবে এই
শক্তি প্রয়োগেরও একটি বৈধতার প্রয়োজন ।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আর
সেটি হয়ে আসছে মধ্যবর্তী নির্বাচন, না হয় গণভোটের মাধ্যমে।
ফলে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জটিলতা বিবেচনায় দৃশ্যত
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা কিংবা সংকটের
সমাধান লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জেদাজেদিতে সংলাপের পথও অনেকটাই রুদ্ধ
হয়ে পড়েছে। ফলে এই সংকট নিরসনে গণভোটই হতে পারে একটা শান্তি
পূর্ণ সমাধান।
আমরা যদি বহি:বিশ্বের প্রতি লক্ষ্য করি, তবে দেখতে পাবো বিভিন্ন
সময়ে বিভিন্ন দেশে যখনই বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে, আর তা অন্য
কোনো পন্থায় সমাধান সম্ভব না হলে নিরসন হয়েছে এই গণভোটের
মাধ্যমেই।
আমরা যদি ইয়েমেন সংকটের দিকে লক্ষ্য করি- দেশটির উত্তরাঞ্চলের
সংখ্যালঘু জাইদি সম্প্রদায়ের অংশ হুথি গোষ্ঠী অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের
দাবিতে ২০০৪ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছে।ইয়েমেনের চলমান রাজনৈতিক
সংকট নিরসনে গত নভেম্বরে একটি বহুদলীয় ‘টেকনোক্র্যাট’ সরকার গঠন
করা হয়। ৩৬ সদস্যের এই মন্ত্রিসভায় শিয়াপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথির
প্রতিনিধিরাও যোগ দেয়। এরপরও সংকটের সমাধান না হওয়ায় ফেব্রুয়ারি
মাসে ইয়েমেনের চলমান সহিংসতা নিরসনের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ
নিরাপত্তা পরিষদে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে সব
পক্ষকেই শিগগির আলাচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। সাংবিধানিক
গণভোট ও নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার কথাও বলা হয়েছে।
সূত্র: গার্ডিয়ান, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)
এছাড়া ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সুদান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়
গণভোটের মাধ্যমেই। দক্ষিণ সুদানের জনগণ মূল ভূখন্ড থেকে নিজেদের
আলাদা করতে গণভোট দেয়।
সম্প্রতি মিশরেও গণভোটে সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট
কিছুটা হলেও সমাধান হয়েছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ততকালীন
স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের পতনের পর দেশটিতে সংবিধান প্রশ্নে
দ্বিতীয়দফা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
গেল নভেম্বরে স্পেন সরকারের হুমকি উপেক্ষা করেই কাতালানে স্বাধীনতার
প্রশ্নে প্রতীকী গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
কয়েক মাস আগে পৃথিবীর অতি বিখ্যাত দেশ যুক্তরাজ্য বা বিলাত
আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম ছিল গণভোট প্রসঙ্গে। ইংল্যান্ড
এবং ওয়েলসের মিলিত নাম হলো ‘গ্রেট ব্রিটেন’। গ্রেট ব্রিটেন এবং
স্কটল্যান্ডের মিলিত নাম হলো ‘যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম’।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা আন্দোলন করেছিলেন এই মর্মে যে,
তারা সম্পূর্ণভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চান। তারা যুক্তরাজ্যের অংশ
থাকতে চান না। মারামারি কাটাকাটি হানাহানি ছাড়াই সিদ্ধান্ত হয়েছিল
যে, বিষয়টি গণভোটে ছেড়ে দেয়া হবে। চার মাস আগে স্কটল্যান্ডের
ভোটাররা ভোটের মাধ্যমে একটি প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রশ্নটি ছিল
আপনারা কি স্বাধীন হবেন? ভোটারদের বেশির ভাগ অংশ উত্তর
দিয়েছেন, না। অর্থাৎ গণভোটের ফলাফল হলো স্কটল্যান্ড স্বাধীন হবে
না।
ইংরেজি পরিভাষায় রেফারেন্ডাম বা বাংলায় গণভোট হলো জনগণের পক্ষ
থেকে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে মতামত প্রকাশের
একটি বিধান বা পন্থা বা সুযোগ। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক,
জনগণই হলো সকল ক্ষমতার উৎস। ফলে এই বিবেচনায় বর্তমান
রাজনৈতিক সংকটের সমাধানও গণভোটের মাধ্যমে হতে পারে।
আমাদের দেশে গণভোট নতুন কিছু নয়, এর আগেও কয়েক দফা গণভোট
হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করতে পারি-
সামরিক শাসনের গণভোট ১৯৮৫, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক
শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ২১শে মার্চ ১৯৮৫ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত
হয়। যিনি ১৯৮২ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব
পালন কালে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং প্রধান সামরিক প্রশাসক
হিসেবে দেশ শাসন করেন। গণভোটে ভোটারদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়,
আপনি কি রাষ্ট্রপতি এরশাদের গৃহীত নীতি সমর্থন করেন এবং আপনি কি
চান, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা
হস্তান্তরের পূর্ব পর্যন্ত তিনি তার প্রশাসন পরিচালনা করবেন?
এতে মোট ৭২.২% ভোট সংগৃহীত হয়েছিল, আর তাতে ফলাফল ছিল
৯৪.৫% হ্যাঁ ভোট। যদিও বিরোধীরা গণভোটের দিন সাধারন ধর্মঘটের
ডাক দিয়ে ফলাফল পূর্ব নির্বারিত বলে দাবি করেছিল।
এছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট ১৯৭৭, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর
রহমানের সময় ৩০শে মে ১৯৭৭ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটারদের
কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল
জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও
কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল? ভোটের ফলাফল ছিল, ৯৮.৯% হ্যাঁ এবং
মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল, ৮৮.১%।
ফলে বর্তমান সংকট নিরসনেও গণভোটের প্রস্তাবটিকে জনগণ ইতিবাচক
হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু সমস্যা হলো- সরকার পক্ষ বলা হচ্ছে- সংবিধান
সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের কোনো ‘প্রবিশন’ নেই। তাই গণভোটের
প্রশ্নই ওঠে না।
কথাটি যত সুন্দরভাবেই উপস্থাপন করা হোক না কেন, গণতান্ত্রিক
রীতিতে এ কথা কতটা যৌক্তিক কিংবা বাস্তবসম্মত তা কিন্তু
প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। গণভোটের বিধান দেশে বিদেশে জনগণের ক্ষমতা
প্রয়োগের অন্যতম মাধ্যম। বিশ্বের ৯৯ ভাগ দেশেই তাদের সংবিধানে
গণভোটের বিধান আছে। আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানেও ছিল। সংবিধান
থেকে গণভোটের এ বিধান বাতিল করার জন্য কোনো দাবি বা কোনো
মামলা ওঠেনি। কিন্তু আজ থেকে চার বছর আগের আওয়ামী লীগ সরকার
তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করার জন্য যখন সংবিধান সংশোধন
করেছিল, তখন ওই ফাঁকের মধ্যে গণভোটের বিধানকেও বাতিল করার কথা
লিখে দেয়। ফলে অনেক বড় জিনিসের মধ্যে এই জিনিসটিও হারিয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের ক্ষমতা বাস্তবায়নের
জন্য, গণভোটের বিধান অতি প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক, জনগণই হলো ক্ষমতার উৎস। জনগণ
তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে, কিছু ব্যক্তিকে সংসদে পাঠায়। ক্ষমতা
প্রয়োগের প্রক্রিয়াটিকে নির্বাচন বলা হচ্ছে। এই নির্বাচন সুনির্দিষ্ট
সময়ের বিরতির পর পর হয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে জনগণের
মতামত প্রকাশের বা মতামত গ্রহণের কোনো প্রয়োজন যদি দেখা
দেয় সেই মতামত প্রকাশ বা গ্রহণ যেন করা যায়, তার জন্য সংবিধানে
গণভোটের বিধান রাখা হয়েছিল।
দেশের বিদ্যমান সংবিধানে গণভোটের কোন বিধান নেই। ফলে জাতীয় ও
জনগুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যুতে জনমতামত যাচাইয়ের কোন সুযোগ নেই। এমনকি
সংবিধানের প্রস্তাবনা, মূলনীতি, ৪৮ ও ৫৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটের
যে বিধান ছিলো পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটিকেও বাতিল করে দেয়া
হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তানসহ গণতান্ত্রিক প্রায় সবদেশে
গণভোটের বিধান থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধানে তা আর নেই। তবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইতিপূর্বে সামরিক শাসকরা তাদের শাসন জায়েজের
জন্য প্রহসনের নির্বাচন করে গণভোটের বিধানের অপব্যবহার সত্য কিন্তু
যদি দেশে কখনও গুরুতর জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বা যদি এমন কোনো
ক্রান্তিকাল হাজির হয় যখন এক বা একাধিক ইস্যুতে জনমতামত যাচাইয়ের
প্রয়োজন পড়তে পারে—সে রকম ক্ষেত্রে তা করার কোনো সুযোগ সংবিধানে
রাখা হয়নি।এটা অগণতান্ত্রিক।ফলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-
উল হকের মতো বিজ্ঞজনদের মতে, সংবিধানে না থাকলেও দেশ, জাতি ও
জনগণের প্রয়োজনে গণভোট যে কোনো সময় হতে পারে।
উল্লেখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, বর্তমানে আমাদের দেশ ও
জনগণ চরমক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশের চলমান রাজনৈতিক
সংকটে জনজীবনসহ সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে এই সংকট নিরসনের
প্রয়োজনীয় সর্বত্রই অনুভুত হচ্ছে। সংলাপ কিংবা অন্য কোনো
পন্থায় সংকট নিরসনের সম্ভাবনা যেখানে দেখা যাচ্ছে না, সেখানে
গণভোটই হতে পারে সমাধানের সর্বোত্তম শান্তিপূর্ণ পথ। গণভোটে
জনগণ যদি মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় তাহলে নির্বাচন হবে। আর যদি
জনগণ না চায় তাহলে বর্তমান সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবে। সেই
সাথে জনগণই নির্ধারণ করবে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন
আছে কি-নাই। জনগণ, চাইলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে, অন্যথা বর্তমান ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
সবশেষে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আহবান জানাবো- দেশ ও জাতির
বৃহত্তর স্বার্থে গণভোটের আয়োজনের মাধ্যমে চলমান সংকটের
শান্তিপূর্ণ সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিন। এর ফলে যেমনটি দেশের
কল্যাণ সাধিত হবে, তেমনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের
কাছে আওয়ামী লীগেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় মিলবে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক, ই-মেইল- sarderanis@gmail.com