নিউজ ডেস্ক: প্রাপ্য বকেয়া বেতন, বাড়ি ফিরে যাওয়ার একটি বিমান টিকিটের আশা তাদের মুখে একটুখানি হাসি নিয়ে এসেছে। যদিও তারা বাধ্য হয়ে থাকছেন পানি ও আলোবিহীন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে একরকম মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশসহ চার দেশের ১০০ শ্রমিক। তাদের পক্ষে আদালত একটি রায় দিয়েছেন।
কিন্তু ৫ মাস শেষ হয়ে গেলেও নিজেদের পাওনা বকেয়া বেতন ও বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিমান টিকিটটির আশায় ১০০ জন শ্রমিক এখনও কেবল অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। খালিজ টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাদের মানবেতর পরিস্থিতি। গত বছরের মাঝামাঝি এ শ্রমিকরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন, সেটি দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এর পরই অসহায় হয়ে পড়েন ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোট ১৯০ জন শ্রমিক। এদের মধ্যে ৩০ জন তাদের নিজেদের অর্থ ব্যয় করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে যান। কিন্তু বাকি ১৬০ জনের সে সামর্থ্য ছিল না।
এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন কিছু সামাজিক কর্মী ও দুবাইয়ে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস। একটি মামলা করা হলে, আদালত শ্রমিকদের পক্ষেই রায় দেয়। গত বছরের নভেম্বরে আদালত প্রত্যেক শ্রমিককে ৯১৪২ দিরহাম ও বিমান টিকিট প্রদানের নির্দেশ দেন ওই প্রতিষ্ঠানকে। বৃহসপতিবার কিছু শ্রমিককে পাওনা বকেয়া অর্থ প্রদান করা হয়েছে। অবশিষ্টদের মধ্যে ৬০ জনকে কয়েকদিনের মধ্যে বকেয়া অর্থ পরিশোধ করা হবে। বাকিদের অপেক্ষা করতে হবে আদালতের পরবর্তী আদেশের জন্য। ২-৩ মাসের মধ্যে ওই আদেশ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওই শ্রমিকদের পক্ষে লড়াই করছেন টিআর রমেশ নামের এক সামাজিককর্মী। তিনি জানালেন, শ্রমিকদের পক্ষে রায় পাওয়ার লড়াই খুব কঠিন ছিল। কিন্তু অবশেষ তাদের যা প্রাপ্য, তা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যখন প্রথম প্রথম তাদের (শ্রমিক) কাছে যেতাম, তখন তারা কাঁদতো। কিন্তু আদালতের আদেশ আসার পর থেকে তারা কিছুটা সুখী। তাদের এখন দরকার পানি ও বিদ্যুৎ। কেননা গত কয়েকদিন ধরে তাদের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে কোম্পানির মালিক। শ্রমিকরা মাঝেমাঝে নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে পানি ও গ্যাস কেনার চেষ্টা করে।
কিন্তু এরপরও দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেনি। কেননা, নিজের দেশে তাদের পরিবার কিংবা প্রিয় মানুষদের পাতে যে খাবার নেই। শ্রমিকরা এখন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিয়ে ঘুমাচ্ছেন অন্ধকারে। একে অপরের সঙ্গে হয়তো শেয়ার করছেন নিজেদের দুঃখের গল্প। সামাজিক কর্মী ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করা শ্রমিকরা তাদের জন্য খাবার জোগাড় করছেন। কিন্তু বৃহসপতিবার থেকে তাদের পানি সংযোগও বন্ধ করে দেয়া হলো! রামশ মান্নাথ নামের আরেক সামাজিক কর্মী জানান, সহকর্মীদের কাছ থেকে অর্থ তুলে তাদের জন্য পানি কিনে দিই আমরা। প্রতিটি পানির ট্যাংকারের দাম পড়ে ৭০০ দিরহাম। আমরা জানি না, কতদিন তাদের সহায়তা করতে পারবো। রমেশের এক সহকর্মী বিভিন্ন সময় ওই শ্রমিকদের জন্য পানি ও গ্যাস কিনতে অর্থ জোগাড় করে দিয়েছিলেন।
সুমন নামের এক বাংলাদেশী শ্রমিক বলেন, আমার স্ত্রীকে যখনই আমি ফোন দিই, তখনই সে আমাকে টাকা পাঠাতে বলে। আমি না হয়, কিছু খেয়ে পরে থাকতে পারি। কিন্তু আমার পরিবারের পরিস্থিতি নিয়ে আমি চিন্তিত। শ্রমিকদের একজন জানালেন, ২১শে ডিসেম্বর তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপর থেকেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। শাহীন নামের এক শ্রমিক বলেন, আমরা অন্য কোমপনিতে কাজ করতে পারি। কিন্তু আমাদের পাওনা আগে পরিশোধ করতে হবে। আমরা অত্যন্ত কঠোর শ্রম দিয়ে এ অর্থ উপার্জন করেছি। এজন্যই আমাদের টাকা চাই। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তার মোবাইল ফোন কিভাবে তিনি চার্জ দেন।
তিনি জানান, মসজিদে গিয়ে মোবাইল চার্জ দিতে পারেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানালেন, যদি আমাদের কারও কাছে টাকা না থাকে, আমরা খাবার ভাগাভাগি করে খাই। যদিও খুব কম খাবারই জোটে। আমাদের অনেকের কাছে এমনকি ১০ দিরহামও নেই। আমরা বিভিন্ন জায়গায় টুকটাক কাজ করে কিছু টাকা পাই। কিন্তু এতে গ্রেপ্তার হবার ঝুঁকি রয়েছে।
জাহাঙ্গির নামের এক শ্রমিক জানান, আমাদের মধ্যে তিনজন জরিমানার অর্থ পেয়েছেন। আমাদের আশা, আমরা সবাই বকেয়া বেতন ও বাড়ি ফিরে যাবার টিকিট পাবো। তিজেন্দর সিং নামের এক ভারতীয় শ্রমিক বললেন, আমাদের শুধু বিদ্যুৎ ও পানি দিন একদিনের জন্য। মাঝেমাঝে আমরা জেগে উঠে কোন পানিই পাই না। আমরা হয় পানি চুরি করি, কিংবা কারও কাছে চেয়ে খাই। তিনদিন ধরে আমি গোসল করতে পারিনি, এমনও হয়েছে বহুবার। তাদের সকলের আশা তারা শিগগিরই ফিরে যাবেন নিজ দেশে। তাদের দেখতে খুব দ্রুতই প্রতিনিধি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।