কাজী সোহাগ: রাজনৈতিক অস্থিরতায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রবাসীদের। দূর দেশে থেকেও দেশের জন্য উদ্বিগ্ন তারা। গর্বের মাতৃভূমির জন্য দুশ্চিন্তায় সময় পার করেন তারা। সমঝোতা আর সংলাপের জন্য দেশে যেমন মানুষের আকুতি তেমনি প্রবাসীরা চাইছেন সমঝোতার মাধ্যমে যেন দেশে শান্তি ফিরে। স্বাভাবিক হয় মানুষের জীবনযাত্রা। স্পেন, ইতালি ও কাতারে থাকা প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের প্রতিক্রিয়া। ইতালির ভেনিস শহরে ছোট্ট দোকানে পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করেন নোয়াখালীর আবদুল জলিল।
বাংলাদেশী সংবাদকর্মী শুনেই শত ব্যস্ততার মধ্যেও আলাপ করার ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। শুরুতেই বলেন, আমরা এখান থেকে অনেক কষ্টে টাকা আয় করে দেশে পাঠাই। আমাদের পাঠানো টাকা দিয়ে আপনারা দেশে এসব কি করছেন। গত কয়েক মাস একদিনও রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। ক্লান্তির কারণে ঘুম এলেও দুঃস্বপ্ন দেখি। আঁতকে উঠি মাঝেমধ্যেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার সঙ্গে যোগ দিলেন আরেক ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলাম। তার বাড়ি শরীয়তপুরে।
তিনি বলেন, দেশ নিয়ে রাজনীতিবিদদের এমন ছিনিমিনি খেলা উচিত নয়। তারা তো মাঝে মধ্যে বিদেশে বেড়াতে আসেন। নানা স্থানে যান। তারপরও শিক্ষা লাভ করেন না। যাদের নিয়ে রাজনীতি তাদের যদি অশান্তির মধ্যে রাখা হয় তাহলে রাজনীতিবিদদের কাছে মানুষ আর কি চাইতে পারে। ভেনিসের বিভিন্ন অলিগলিতে দেখা মিললো ১০/১৫ জন বাঙালির। পর্যটকদের জন্য তারা বিক্রি করেন ক্যামেরায় সেলফি তোলার স্টান্ড। সামান্য আয়ে নিজেদের জীবনধারণই তাদের জন্য অনেক কঠিন। এর মধ্যেও দেশে টাকা পাঠাতে হচ্ছে নিয়মিত। টাকা পাঠিয়ে হয়তো কিছুটা শান্তি পাই তবে আতঙ্কে থাকি রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় থাকা স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে। এমনটা জানালেন মানিকগঞ্জের ঘিওরের বাসিন্দা হাফিজুল।
তিনি বলেন, ছেলেকে নিয়মিত স্কুলে আসতে হয়। সঙ্গে স্ত্রীকে। যেভাবে পেট্রলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়িতে আগুন দেয়া হচ্ছে তাতে টেনশনে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ইতালির এই প্রবাসীদের সুরে একই কথা অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে স্পেনের বার্সেলোনা ও কাতারের দোহায়। বিদেশের মাটিতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও অশান্তির আগুনে জ্বলছেন তারা। মা, বাবা, ভাই, বোন আত্মীয়স্বজনের চিন্তায় অস্থির থাকতে হয় প্রতি মুহূর্ত। বিশেষ করে যারা রাজধানী ঢাকা কিংবা জেলা শহরে বসবাস করছেন তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেশি। এরই মধ্যে বেশ কয়েক প্রবাসী বার্ন ইউনিট ও পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেককে সহায়তায় এগিয়ে গেছেন। টাকা পাঠিয়েছেন মৃত্যুপথযাত্রী আহতদের সুস্থতায়। এ উদ্দেশে টাকা পাঠাতে চান না তারা। এ উপকার তাদের জন্য বড়ই অস্বস্তিকর। এমনটা জানালেন বার্সেলোনায় প্রায় ২০ বছর ধরে বসবাসকারী শরীয়তপুরের হাকিম আহমেদ।
তিনি বলেন, কোথায় দেশের উন্নয়নের জন্য আমাদের পাঠানো টাকা ব্যয় হবে। উল্টো জীবন বাঁচাতে ব্যয় হচ্ছে। কাতারের দোহায় ৩০ বছর ধরে প্রবাসী কুষ্টিয়ার তপন। ঠিকাদারী ব্যবসা করে এরই মধ্যে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। দেশের রাজনীতি ও উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত তিনি। দেশে ফায়ার ফাইটিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার স্বপ্ন তার। প্রজেক্টের রূপরেখাও তৈরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাতার সফরে গেলে বিষয়টি সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত জানানো হয়। রাজি হন প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গে থাকা মন্ত্রীদের ইন্ডাস্ট্রি গঠনে সহযোগিতা করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটে আপাতত পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন ব্যবসায়ী তপন।
তিনি বলেন, এ অবস্থায় বিনিয়োগ করাটা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। তপনের মতো এরকম অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ ঝুঁকি এড়িয়ে চলছেন। দোহারের কয়েক প্রবাসী জানান, আগে এখান থেকে আয় করে টাকা পাঠানো হতো দেশে। আর এখন পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দেশে থাকা সম্পদ বিক্রি করে বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিদেশের মাটিতে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটলে হয়তো প্রবাসীরাও ঝুঁকবেন দেশের মাটিতে।