রাজিব শর্মা: চলমান বিশ্বকাপের সাম্প্রতিক কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ খেলা নিয়ে বিতর্কে অযথা যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা ভুল কূটনীতির একটি উদাহরণ।
ওই খেলায় পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পরাজয় নিয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। অন্যায় আম্পায়ারিং সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী করেছেন ভারতকে। তারা এমনকি কোয়ার্টার ফাইনাল জেতার জন্য ভারতের দ্বারা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পর্যন্ত দিয়েছে। আর ক্রিকেটের শীর্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)কে তারা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আখ্যা দিয়েছেন।
এ ধরনের মন্তব্য অপ্রীতিকর এবং এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। এগুলো তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে জড়িয়ে পড়াকেই বেছে নিয়েছেন। তিনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা তার মর্যাদার সঙ্গে মানায় না। হাসিনা বলেছেন, সবাই দেখেছে কিভাবে বাংলাদেশ দলকে হারানো হয়েছে। মেলবোর্নে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জন্য প্রবাসীদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে ফোনে যোগ দেন হাসিনা। তার বিমর্ষ দলকে সান্ত্বনা দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি একদম সঠিক ছিলেন।
কিন্তু তার ক্রিকেট দলকে উৎসাহ দিতে গিয়ে তিনি বেশিই বলে ফেলেছেন। হাসিনার প্রাসঙ্গিক একটি উদ্ধৃতি ছিল: ‘আম্পায়াররা ভুল সিদ্ধান্তগুলো না দিলে আমরা জয়ী হতাম। সবাই দেখেছে কিভাবে আমাদের হারানো হয়েছে।’ শেখ হাসিনার মতো প্রথিতযশা একজন রাজনীতিক, যিনি তার দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন- তার কাছ থেকে এমন মন্তব্য কেউ আশা করেন না।
যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া যাক আম্পায়ারিং সিদ্ধান্তগুলো ত্রুটিপূর্ণ ছিল আর শুধুমাত্র আম্পায়ারিং ভুলের কারণেই বাংলাদেশ ভারতের কাছে হেরেছে। এ তত্ত্বে বিশ্বের কোন বিশেষজ্ঞই কখনও সম্মত হবেন না। তারপরও প্রধামনমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির অনুচিত একটি বিতর্কে যোগ দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। এটাই প্রথম নজির যখন ক্রিকেট প্লেইং কোন দেশের সরকারপ্রধান এমন মন্তব্য করেছেন। এটা উদ্বেগের কোন ধারা শুরু করে দেয়ার আগে এবং ক্রিকেটকে বদনাম করার আগে হাসিনার মন্তব্যকে নিন্দা জানানো প্রয়োজন। প্রথমত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এসব মন্তব্য করে ঠিক নিজেদেরকে মহিমান্বিত করছেন না।
এসব মন্তব্যের পেছনে না কোন দৃঢ় তথ্য-প্রমাণ আছে, না কখনও তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সমর্থন করা সম্ভব হবে। বিসিবি ইতিমধ্যে শিশুসুলভ আচরণ করেছে। খেলার ময়দানে একটি হার নিয়ে নিজেকে মানাতে পারছে না, যেন ক্রন্দনরত শিশু। হাসিনা তার মন্তব্যের মাধ্যমে ক্রিকেট জগতে অযৌক্তিক এ নাট্যমঞ্চে আস্থার যোগান দিয়েছেন। এটা শুধু ক্রীড়াসুলভ উদ্যোগের পরিপন্থি তা-ই নয় বরং এটা বাজে একটি পূর্ব-নজির সৃষ্টি করলো। মানুষ আশা করবে অন্যান্য পরাজিত ক্রিকেট খেলুড়ে জাতি এটা অনুকরণ করবে না। ভারত এর আগে অনেক বিশ্বকাপে বাজে নৈপুণ্য দেখিয়েছে। হাড্ডাহাড্ডি অনেক খেলায় প্রাথমিকভাবে আম্পায়ারিং ভুলে হেরেছে।
কিন্তু অতীতে কখনও কি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বা শীর্ষ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কোন গুঞ্জন পর্যন্ত এসেছে? শেখ হাসিনার জানা উচিত, এমন অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করে তিনি শুধুমাত্র খেলার উদ্যমকে লঙ্ঘন করছেন তাই নয়, বরং তিনি তার নিজ ক্রিকেট দলের স্বার্থেরও ক্ষতি করছেন। ভারত কি হোম-সিরিজের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাবে, যেটা বিসিবি প্রেসিডেন্টদের অনুরোধ সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে হয়নি? বর্তমান পরিস্থিতিতে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর অনুমান করলে কোন পুরস্কার নেই অবশ্য। বাংলাদেশ দুদশকের বেশি সময় টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে। কিন্তু সবসময়ই মানের নিচে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে।
এতে করে প্রশ্ন উঠেছে, কেন তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস বাতিল করা হবে না? বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ রয়েছে যখন বাংলাদেশ তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এবং গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বকাপের মঞ্চে তাদের হতাশায় ঝরিয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক শীর্ষ দল বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হয়েছে। এটা সত্যি যে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে বীরের মতো খেলেছে। এমনকি এবারের বিশ্বকাপ যাত্রায় তাদের সমালোচকদেরও আপন করে নিয়েছে। তাদের যাত্রা থেমেছে ভারতের হাতে।
কিন্তু মাঠের ফলাফলকে মাঠের বাইরের অভিসন্ধির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা উপচে পড়া দুধ নিয়ে কান্নাকাটি করার মতো। অন্য খেলাগুলোর মতো ক্রিকেট এমন একটি খেলা যা একত্রিত করে মানুষকে, দেশকে ও মহাদেশকে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এমন প্রাসঙ্গিক আর কোন খেলা নেই, যে একীভূত ক্ষমতা আছে ক্রিকেটে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টেস্ট মর্যাদার দিক দিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা হলো বৃহৎ ক্রিকেট দল। এরা সবাই বিশ্বকাপ ক্রিকেট বিজয়ী। এরই মধ্যে ভারত দুবার এ সফলতা লাভ করেছে। এখানে অন্য খেলুড়ে ক্রিকেট জাতি হলো বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। নেপালেও ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন সময়ের ব্যাপার যখন হিমালয় দুহিতা এই ছোট্ট দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের নাম লেখাবে।
ফলে সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে ৬টি দেশই ক্রিকেটপাগল জাতি। এসব দেশে ক্রিকেট এখন শুধু একটি খেলা নয়। রীতিমতো পূজনীয় হয়ে উঠেছে। কূটনীতির সম্প্রসারণও ঘটেছে ক্রিকেটের মাধ্যমে। বলিউড দীর্ঘদিন ভারতীয় কূটনীতির একটি কার্যকর মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল ঠিক সেরকমই হয়ে উঠেছে ক্রিকেট।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে সামনে রেখে এ অঞ্চলের ক্রিকেট খেলুড়ে জাতিকে এগিয়ে এসে তাদের সফলতা প্রত্যাশা করার আহ্বান জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর মাধ্যমে তিনি সার্কভুক্ত দেশগুলোতে কূটনীতিতে ব্যবহার করেন ক্রিকেট। তিনি এ অঞ্চলে ক্রিকেট ব্যবহার করে যে কূটনীতি চালু করেছেন তার নাম দেয়া হয়েছে সার্ক যাত্রা। এর মধ্যে বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে পড়াটাকেই বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হাসিনা অবশ্যই জানেন যে, একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব তার পরাজিত ক্রিকেট দলকে ইতিবাচক কায়দায় উৎসাহী করা এবং যে ভূতের অস্তিত্ব নেই সে প্রসঙ্গ টেনে না আনা। শেখ হাসিনাকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে এবং ক্রিকেট ম্যাচকে রাজনীতিকরণ করা থেকে দূরে থাকতে হবে।
(গতকাল অনলাইন ফার্স্ট পোস্টে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)