আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: গণিতের অধ্যাপক হার্ব সিলভারম্যান ‘সেক্যুলার কোয়ালিশন অব আমেরিকা’র প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান সভাপতি। তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর একজন নিয়মিত কলামিস্টও। ইহুদি মায়ের সন্তান এই আমেরিকান অধ্যাপক ইহুদিবাদী ইসরাইলের নীতির একজন সমালোচক।
হাফিংটন পোস্টে সিলভারম্যান ‘কেন আমি আর ইসরাইলকে সমর্থন করি না’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিচে পাঠকদের জন্য সেটির অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-
১৯৪৮ সালের ১৪ মে যখন ইহুদীদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হল তখন আমার পরিবারের সদস্যদেরকে আনন্দে অশ্রুপাত করতে দেখেছি। তখন আমি পাঁচ বছরের শিশু। তাই তাদের সেই অশ্রুপাতের অর্থ বুঝতে পারিনি। তখনই আমাকে শেখানো হয়েছিল ইহুদীবিরোধীদের অনিষ্ঠ কামনাই ধর্মের মৌলিক কাজ। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশকিছু লোক ছিলেন যারা তাদের নিজের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন। তাদের অনেকে আবার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেও (ইহুদি নির্যাতন শিবিরে) দিন কাটিয়েছেন। আমার অনেক আত্মীয় হলকস্টে মারা গিয়েছিলেন। তখন আমার বাবা-মা ‘গয়িম’দেরকে কখনো বিশ্বাস না করতে হুঁশিয়ার করেছিলেন। (‘গয়িম’ শব্দটির অর্থ পশু। কট্টর ইহুদিবাদীরা তাদের বাইরে সবাইকে এটা বলে সম্বোধন করত)।
বড় হয়ে যখন আমি ধার্মিক ইহুদি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকলাম তখনও ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে অনেক ক্ষেত্রেই ইহুদিদের এই ভূমির প্রতি টান অনুভব করতাম। ইসরাইলে গিয়ে বাড়িঘর করার কোনো ইচ্ছা কখনো ছিল না আমার। আমি এই দেশটাকে ভবিষ্যৎ হলোকস্ট এর বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ হিসেবে দেখি।
আরো অনেক পরে আমি বুঝতে শুরু করি যে, ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আসলে সব মানুষের জন্য এক নিখাঁদ আনন্দের উপলক্ষ ছিল না। কারণ, ইহুদিরা যে জায়গাকে তাদের দেশ বানালো সেখানে অন্য মানুষদের বাড়িঘর ছিল। সেই মানুষদের অনেককে তাদের বাড়িঘর থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়েছিল। অন্যভাবে বললে, ঘরহীন ইহুদিদের আশ্রয় দিতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি মানুষদের ঘরহীন করা হল। কিন্তু এরপরও আমি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের ইহুদিবিরোধিতা এবং ইসরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করার ব্যাপারটি মাথায় রেখে দেশটিকে সমর্থন করে যাচ্ছিলাম।
যদিও আমি ইসরাইলের নিরাপত্তা এবং ফিলিস্তিনীদের মানবাধিকার উভয়ই রক্ষা করে চলার নীতির সমর্থক।
সব ইহুদির ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার অধিকারের ব্যাপারে দেশটিতে যে আইন রয়েছে সেটাকে আমি মেয়াদোত্তীর্ণ মনে করি। যেসব ইহুদি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হুমকির মূখে জীবনযাপন করছে তাদের ইসরাইলে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার মা ইহুদি ছিলেন বলে আমাকে নাগরিকত্ব দিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে নই আমি। আমার চেয়ে ঘরহারানো ফিলিস্তিনীদের সেখানে ফিরে যাওয়ার অধিকার কি বেশি নয়? আমার এই মতের সাথে ইসরাইলের বাইরে থাকা বেশিরভাগ ইহুদি দ্বিমত পোষণ করেন এবং তারা সব ইহুদিদের ‘ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার অধিকার’কে সমর্থন করেন। অথচ, তারা সেখানে জীবনে কখনো ছিলেনও না এবং যাবেনও না।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ইরানের সাথে বিভিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা এবং প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ না করে নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানানো স্পিকার জন বোয়েনারের উচিত হয়েছে কিনা এসব বিষয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে।
‘ইসরাইলের বাইরের সব ইহুদি নির্বাসনে আছেন এবং তাদের উচিত দেশটির নাগরিক হয়ে যাওয়া’- নেতানিয়াহুর ইহুদিবাদী এই ধ্যানধারণার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই আমি। সম্প্রতি আমার একটি লেখায় বলেছি যে, দেশপ্রেম হচ্ছে নিজের দেশের ভুল খুঁজে বের করে সেটা সংশোধনে কাজ করা।
একজন দেশপ্রেমিক আমেরিকান হিসেবে নেতানিয়াহু কর্তৃক আমাকে ‘নির্বাসিত’ বলার নিন্দা জানাই। আমি সাউথ ক্যারোলিনার চার্লেস্টনে থাকি যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরানো সিনাগগ অবস্থিত এবং প্রতিনিয়ত এটিতে পূণ্যার্থীদের ভিড় হয়। আমি এই সিনাগগের এক রাব্বীর কথাই তুলে ধরতে চাই যিনি ১৮৪১ সালে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এই দেশ আমার ফিলিস্তিন, এই শহর আমার জেরুজালেম।’
মাস কয়েক আগে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর নেতানিয়াহু ইউরোপের সব ইহুদিদেরকে পালিয়ে গিয়ে ইসরাইলের নাগরিকত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আচ্ছা, তিনি আসলে কোথায় তাদের জায়গা দেবেন? বুলডোজারের তলায় পিষ্ট করে দেয়া ফিলিস্তিনীদের বাড়ি আর খামারে, তাইতো? কিন্তু ইহুদিরা যেসব দেশে আছেন সেখান থেকে পালানোর চেয়ে ওই দেশেই নিজেদের জন্য ভাল পরিবেশ তৈরি করে নিলে সমস্যা কোথায়?
মনে হচ্ছে, নেতানিয়াহু হিটলারের ‘ইহুদিমুক্ত ইউরোপ’ এর স্বপ্ন পূরণে নেমেছেন।
আমি একমাত্র যে কারণে ইসরাইলের নাগরিকত্ব নিতে রাজি আছি সেটা হচ্ছে, আমি দেশটির কিছু ভয়ংকর নীতি পরিবর্তন করতে চাই (এটা না হলে রাজি নই)।
১৯৪৮ সালের ইসরাইলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এমন একটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার সমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
অথচ, সম্প্রতি ইসরাইলি মন্ত্রিসভা যে বিল অনুমোদন দিয়েছে সেখানে দেশটিকে ইহুদিদের ‘জাতিরাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে শুধু ইহুদিরাই জাতীয় অধিকার প্রাপ্ত হবে। এটা এখনো আইনে পরিণত হয়নি, তবে এই অগণতান্ত্রিক বিলের মাধ্যমে দেশটির ২০ শতাংশ অ-ইহুদি আরব নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণীর বলে গণ্য হবেন! এটা স্বাধীনতার ঘোষণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল ভুল পথে হাঁটছে। আমি আবারো দেশটির সমর্থক হবো যদি এটি তার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে জাতিগত বিদ্বেষের উর্ধ্বে নিয়ে আসতে পারে এবং এর সব নাগরিককে সমান মর্যাদা দিতে পারে।