মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:২৭

হ্যারিকেন স্যান্ডির তাণ্ডবে ৯ মার্কিন অঙ্গরাজ্য লণ্ডভণ্ড

হ্যারিকেন স্যান্ডির তাণ্ডবে ৯ মার্কিন অঙ্গরাজ্য লণ্ডভণ্ড

শহীদুল ইসলাম: যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে তীব্র বেগে আঘাত হেনেছে প্রলয়ংকরী হ্যারিকেন স্যান্ডি। গতকাল এর রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঝড়ে অন্তত: ৪৮ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৮ জন নিউইয়র্কের। যুক্তরাষ্ট্রে স্মরণকালের এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি স্থানীয় সময় সোমবার রাতে

নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ওয়াশিংটনসহ নয়টি অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে।

পূর্ণিমার প্রভাবে ১৪ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে পানিতে তলিয়ে গেছে আটলান্টিক সিটি, নিউজার্সি ও নিউইয়র্কের কয়েকটি উপকূলীয় এলাকা। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে নিউজার্সির উপকূল। ১৫টি রাজ্যে বিদ্যুিবহীন হয়ে পড়েছে ৭৫ লাখের বেশি মানুষ। নর্থ ক্যারোলিনা থেকে কানাডা সীমান্ত পর্যন্ত পুরো এলাকা বিদ্যুত্ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঝড়ের কারণে ইতিমধ্যে প্রাথমিক ক্ষতি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে বলে মার্কিন প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নির্বাচনী প্রচারণা আপাতত স্থগিত :এদিকে নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে স্যান্ডির কারণে নির্বাচনী প্রচার থেকে সরে এসেছেন দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামা ও মিট রমনি। দুইজনই ঝড় কবলিত লাখ লাখ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করে নির্বাচনী প্রচার স্থগিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা রবিবারই নির্বাচনী প্রচারাভিযান বাতিল করে হোয়াইট হাউজে ফিরে গেছেন।

হোয়াইট হাউজে বসে দুর্যোগ পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি ঝড়ের বিষয়ে জাতিকে সতর্ক করে সরকারি ঘোষণা মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি ঝড়টিকে ‘মারাত্মক ও ভয়াবহ’ মন্তব্য করে নগরবাসীর সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। তিনি এই দুর্যোগকালীন অবস্থায় সরকার সবার আগে এবং সবচেয়ে আন্তরিকভাবে নাগরিকদের পাশে থাকবে বলেও অঙ্গীকার করেন।

ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত জনজীবন :স্থানীয় সময় সোমবার দুপুর থেকেই প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। সঙ্গে বৃষ্টি। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বাতাসের তীব্রতা। বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গাছ উপড়ে পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ির ওপর এবং কোন কোন জায়গায় বাড়ির ওপর গাছ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কয়েকটি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। নিউজার্সির আটলান্টিক সিটি, নিউইয়র্কের কুইন্স, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড, লং আইল্যান্ড, ম্যানহাটনের ডাউন টাউন এলাকায় বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। নিউইয়র্ক হারবারে (হাডসন রিভার) পানির উচ্চতা বেড়ে যায় ৩২ ফুট।  পার্শ্ববর্তী লোয়ার ম্যানহাটনের ব্যটারি পার্ক ১৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়।

৭৫ লাখের বেশি বাড়ি-ঘর ও প্রতিষ্ঠান বিদ্যুত্হীন

গতকাল রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৭৫ লাখের বেশি বাড়ি-ঘর ও প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন বলে ঘোষণা দেয়া হয়। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সু্্বিধাসমৃদ্ধ দেশটির বাসিন্দাদের এই সময় চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ১০ লাখ লোককে বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র

রবিবার নিউইয়র্কে ৭৬টি সরকারি স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে যারা সরে যেতে চায়নি তাদের নিজ দায়িত্বে বাড়িতে থাকতে বলে পুলিশ। সেসব লোকজনের একটি তালিকাও তৈরি করেছে পুলিশ। এছাড়া বিদ্যুত্ সংযোগ না থাকায় কয়েকটি হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে তোলা হয়। ল্যাং ওয়ান নামের একটি মেডিক্যাল সেন্টার জানায়, তাদের ব্যাকআপ বিদ্যুত্ সুবিধা শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা সব রোগীকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।

স্থবির হয়ে পড়েছে কয়েকটি রাজ্য

সোমবার রাত ৮টায় প্রলয়ংকারী রূপ নিয়ে ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি উপকূল অতিক্রম করে স্যান্ডি। নিউজার্সি, নিউইয়র্ক, মেরিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া ও কনেকটিকাটে মৃত্যুর খবর পুলিশ দিয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন ঝড়ে গাছ উপড়ে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার রবিবার থেকেই ঝড়টিকে ‘প্রাণহানিকর, মারাত্মক’ ঘোষণা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে ব্যাপক প্রচার শুরু করে। ফলে রবিবার সন্ধ্যা থেকেই রাস্তায় লোক চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে মেট্রো বাস, ট্রেন ও ফেরি সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। সোমবারও সেসব সার্ভিস বন্ধ ছিলো। স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালতসহ বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি অফিস ও সংস্থা বন্ধ ছিলো। ফলে রাস্তায় লোক চলাচল ছিল না বললেই চলে। মঙ্গলবারও এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভিন্ন এয়ারলাইন্স তাদের ১৪ হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করে। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগের এই ঝড়ের কারণে ওয়াল স্ট্রিট বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এমন ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে কেউ কেউ উত্তাল সমুদ্রে সার্ফিংয়ের মতো বিপজ্জনক রাইডে মেতে ছিলেন। অনেকেই বিচে সমুদ্রের এই রুদ্ররূপ দেখতে এসেছিলেন।

আবহাওয়া দপ্তরের সতর্ক বার্তা

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, পূর্বাভাসে যখন হারিকেন স্যান্ডি আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হয়েছিল গতিবেগ বেড়ে যাওয়ায় তার চেয়ে কিছুটা আগেই তা আঘাত হেনেছে। অতীতের অন্যান্য ঝড়ের মতো এই ঝড়ের প্রকৃতি এক হলেও গতিবেগের কারণে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি। অন্যান্য হারিকেন ও মৌসুমি ঝড় উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আঘাত করেছে। আর স্যান্ডি এসেছে দক্ষিণ দিক থেকে। এটাই এসময়ে এ ঝড়ের সবচেয়ে বড় অস্বাভাবিকতা। ঝড়টি আকারে অনেক বড়। এটি কেন্দ্র থেকে  ২০০ মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিলো। আর মৌসুমি ঝড়গুলো কেন্দ্র থেকে ৫০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। গতিবেগ হয় ঘণ্টায় ৬০ মাইল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার জানিয়েছে, হ্যারিকেন স্যান্ডি স্থলভাগে উঠে এসে এখন পোস্ট ট্রপিক্যাল ঝড়ের রূপ নিয়েছে। আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি রাজ্যে তাণ্ডব চালিয়ে ও বৃষ্টি ঝরিয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি পশ্চিম ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া ও কেন্টাকিতে ৩ ফুট পর্যন্ত তুষারপাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে স্যান্ডির প্রভাবে।

রাত ৮ টায় আঘাত হানে স্যান্ডি

সোমবার স্থানীয় সময় রাত ৮ টায় আটলান্টিক সিটির কাছাকাছি পূর্ব উপকূলে প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টিতে ভূমিধস হয়। ফলে আটলান্টিক সিটির বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। সিটি গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, পর্যটন নগরী আটলান্টিক সিটিতে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে তিনি ঝড়ে নাকি হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আটলান্টিক সিটিতে লোকজনের ভোগান্তির জন্য তিনি আটলান্টিক সিটির মেয়র লরেঞ্জো ল্যাংফোর্ডকে দায়ী করে বলেন, বাড়ি-ঘর প্লাবিত হওয়ার আশংকা থাকলেও মেয়র লোকজনকে বাড়িতে অবস্থান করার জন্য উত্সাহিত করেছেন। গভর্নর বলেন, এখন আমাদের কোন উপায় নেই। আমরা সেখানে যেতেও পারবো না লোকজনকে উদ্ধারও করতে পারবো না।

নিউইয়র্কের কয়েকটি জায়গায় গাছ উপড়ে পড়ে। নিউইয়র্কের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা ম্যানহাটনের একটি নির্মাণাধীন হাইরাইজ ভবনের ক্রেন বাতাসের বেগে ভেঙে ঝুলে পড়ে। তবে সেটি নিচে না পড়ায় কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে নিউজার্সিতে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে নিউজার্সির উপকূলীয় এলাকা। মার্কিন কোস্ট গার্ড নর্থ ক্যারোলিনায় এইচএমএস বাউন্টি নামের একটি পরিত্যক্ত জাহাজ থেকে ১৬ জন ক্রুর মধ্যে ১৪ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং এক নারীকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

ভালো আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা

ঝড়কবলিত এলাকাগুলোতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রবিবার থেকেই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা নিয়ে টেলিফোনে খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করেন স্বজনরা। তারা বাংলাদেশ থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে ফোন করে খোঁজ নেন। লং আইল্যান্ড, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ও নিউজার্সির কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অনেকেরই ফোনে চার্জ ছিলো না। ফলে তাদের কারও কারও ফোনে স্বজনরা সংযোগ পৌঁছাতে না পেরে আতংকিত হয়ে পড়েন। তারা নিউইয়র্কের অন্যান্য স্থানে বসবাসরত পরিচিতদের কাছে ফোন করে এমন উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন।

এদিকে লং আইল্যান্ডসহ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে জানা গেছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আব্দুল মোমেন টেলিফোনে এ প্রতিবেদকের খোঁজ নেন। এ সময় তিনি জানান, নিউইয়র্ক ও নিউজার্সিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর তিনি পাননি।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024