শীর্ষবিন্দু নিউজ: আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ আজকের এই দিনে বাংলার মানুষের দুখু মিয়া পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জাতীয় এই কবির ১১৪তম জন্মবার্ষিকী আজ। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ। মা জায়েদা খাতুন। খুব ছোটবেলায় নজরুলের বাবা-মা মারা যান। তারপর শুরু হয় দারিদ্র্য এবং অন্যসব প্রতিকূলতার সঙ্গে তার লড়াই। ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল বলে নজরুলের ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া।
গ্রামের মক্তব থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন নজরুল। মাত্র বারো বছর বয়সে যোগ দেন গ্রামের লেটো গানের দলে। গ্রামের মক্তবেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। তারপর আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানে এক বাঙালি পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে যান তিনি। সেই অফিসার তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর হাবিলদার হিসেবে যোগদান করেন। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
বাংলায় সর্বোচ্চসংখ্যক তিন সহস্রাধিক গানের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। নিজস্ব ধারার সংগীত রচনা করেছেন তিনি। প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত কবি মানুষের সংকীর্ণতা, দীনতা, মূঢ়তা, নিচতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছেন। ‘দুখু মিয়া’ বাংলার দামাল ছেলের প্রতীক। তিনি বিদ্রোহী, তিনি সংগ্রামী, তিনি প্রেমিক, তিনিই শান্তির বর্তাবাহক। কবি নজরুল তাঁর প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন, জাগ্রত করেছেন জাতীয়তাবোধ। কবির কলম শাসকের অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিমান ছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের দেশপ্রেমের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার গান যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা এবং অবরুদ্ধে স্বদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস জুগিয়েছে, উদ্দীপ্ত করেছে। যুগে যুগেই এমনটি ঘটেছে। যখনই শোষক গোষ্ঠীর কালো হাত অসহায় মানুষের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে উদ্ধত হয়েছে, এদেশের মানুষ ছুটে গেছে নজরুলের সৃষ্টির কাছে। তার ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’ কিংবা ‘শিকল পরা ছল মোদের ঐ শিকল পরা ছল’ গানের বাণী তাদের উজ্জীবিত করেছে শোষকের বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বিদ্রোহী হতে। বিদ্রোহী সে জনতার কাছে অত্যাচারী শাসকরা বারবার পরাস্ত হয়েছে।
নজরুল কিন্তু এর মধ্যেও তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। সাংবাদিক হিসেবেও দেখিয়েছেন কৃতিত্ব। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে নবযুগ, লাঙ্গল ও ধূমকেতু পত্রিকা। নজরুলের প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল ‘মুক্তি’। কিন্তু তাকে খ্যাতি এনে দেয় ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতা। এ কবিতার কারণে পরবর্তীতে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি রচনা করে নজরুল ব্রিটিশ শাসকদের ব্যঙ্গ করেছিলেন। এ কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়।
তবুও লেখালেখি ছাড়েননি নজরুল। একের পর এক কালজয়ী সব লেখা সৃষ্টি করেছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাকশক্তি হারান। নজরুল তার সাহিত্য কর্মের জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধি দেয়। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডি. লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়।
আমরা তাকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্মান দিয়েছি। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তিনি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। কিন্তু তার প্রাপ্য সম্মানের পুরোটা কি আমরা দিতে পেরেছি? এদেশের একটি মহল নজরুলকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে চায়। তারা অন্য অনেককে দিয়ে যতটা উৎসাহী, নজরুলকে দিয়ে ঠিক ততটাই অনুৎসাহী। এরা ভিন্ন সংস্কৃতির পুজারী। এদেরই কারণে নজরুলকে নিয়ে যথার্থ গবেষণা আজও হয়নি। নজরুল চর্চায় তারা সুকৌশলে নানাভাবে সৃষ্টি করে চলেছে বাধা-বিঘ্ন। ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নজরুল ইনস্টিটিউট এখন কতোটা সচল সে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত নয়। কারণ নজরুল বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কার্যক্রম এখন আর চোখে পড়ে না।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের পথের দিশারী, ধ্রুবতারা। তিনি এদেশের মানুষের বড়ো আপন, অত্যন্ত কাছের। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন চিরদিন সবার মণিকোঠায়। আজ এই মহান কবির শুভ জন্মদিনে আমরা তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
Leave a Reply