শীর্ষবিন্দু নিউজ: অনেক দিন আগে থেকে কোন্দল চলে আসছে সিলেট আওয়ামীলীগে। যদিও এটা একান্তই আওয়ামীলীগের ঘরোয়া ব্যাপার।কিন্ত এবার যেন তলের বেড়াল বেড়িয়ে আসলো প্রকাশ্যে। সিলেট আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সিনিয়র নেতাই বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে না প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) মেয়র হিসেবে আর কামরানকে দেখতে চান না তারা। নানা কারণেই স্থানীয় আওয়ামীলীগের একটি শক্তিশালী গ্রুপ কামরানের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। সিসিক নির্বাচনে কামরানের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও মনে প্রাণে তারা কামরানের পক্ষে কাজ করবেন না বলে জানালেন। আর তাই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে তাকে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হবে বলে জানালেন সিলেটের রাজনীতি সচেতন মহল।
কামরানের বিভিন্ন অভিযোগের ফিরিস্তি তলে ধরে সিলেট আওয়ামীলীগে নেতাকর্মীরা বলেন, কামরানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে, উত্থাপন করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেন, কামরান গত ২০ বছর ধরে মেয়র পদে আছেন। কিন্তু নগরীর বাহ্যিক কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি তিনি। সরকারি অর্থ লুটপাট করেছেন। লুটপাটের টাকায় তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। পক্ষান্তরে দলীয় নেতাকর্মীদের দিকে তিনি ফিরেও তাকাননি। পাশাপাশি নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতায় মহানগর আওয়ামী লীগকে তিনি কার্যত বিকল করে রেখেছেন। নতুন নেতৃত্বও সৃষ্টি করেননি। দলীয় নেতাকর্মীদের কোন পৃষ্ঠপোষকতা না করে নগরীর উন্নয়নকাজ তার পছন্দের লোক দিয়ে করিয়েছেন। দল ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোন লাভ হয়নি। তার কারণেই মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
আওয়ামীলীগের নেতাদের অনেকেই কামরানের প্রতি বিষাদগার করে বলেন, কামরান নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ৮০’র দশকের প্রারম্ভে মধ্যপ্রাচ্য যান। অনেক কষ্টে সেখানে ঠিকতে না পরে মাত্র দু’লাখ টাকা নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে এলাকাসীদের অধিক উৎসাহে ও সার্বিক সহযোগিতায় পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার পদে নির্বাচিত হোন। ধাপে ধাপে তিনি সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে সিলেট সিটি করপোরেশনের ঘোষণা হলে ২০০৩ সালে সিলেটের ইতিহাসে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনেও তিনি কারাবন্দী অবস্থায় বিপুল ভোটে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন।
কামরানের ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার ও বিএনপির একনিষ্ট একজন নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে শীর্ষবিন্দুকে জানান, আমরা ছোটবেলা থেকে কামরানকে দেখে আসছি। কিছুই ছিলো না তার। শুধু নিজের অমায়িক ব্যবহারই ছিল একমাত্র সম্ভল। যা দিয়ে কামরান জয় করে নিয়ে ছিল প্রথমে তার নিজের এলাকা সিলেটের ছড়ারপাড়ের বাসিন্দাদের। পরবর্তীতে কামরান এই মুগদ্ধা ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেট নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে। সাবেক এই ওয়ার্ড কমিশনার আরো বলেন, পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কামরানের জীবন পাল্টে যেতে থাকে। অর্থ বিত্ত আর প্রাচুর্যের নাগাল পান। এভাবেই কামরান এখন সিলেটের অন্যতম শীর্ষ ধনী। তার কি পরিমাণ সহায়-সম্পত্তি ও অর্থ আছে তা তিনি নিজেও জানেন না। সম্পত্তির মধ্যে কিছু নিজের নামে থাকলেও বেশিরভাগই রাখা আছে স্ত্রী ও সন্তানের নামে। অথচ গত ২০ বছরে অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়লেও দলীয় নেতাকর্মীদের দিকে ফিরেও তাকাননি তিনি। একসময় যারা তার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করেছে মেয়র হওয়ার পর তিনি তাদেরই প্রথম দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। এই সাবেক ১৪নং ওয়ার্ড কমিশনার অভিযোগ করে বলেন, তার অনেক জন সর্মথন থাকা সত্ত্বেও শুধু কামরানের সাথে তার বিরোধীতার কারণে তিনি গত সিটি নির্বাচনে হার মেনে নিতে হয়েছে। আর সদ্য সাবেক ১৪ নং ওয়াডের বর্তমান কমিশনার কামরানের খুবিই ঘন্ষ্টি বলে তিনি জানান। তিনি চ্যালেঞ্জ চুড়ে দিয়ে বলেন, এবার দেখি কামরান বা তার দল-বল আমাকে কিভাবে হারায় আর কামরানই বা কিভাবে মেয়র হোন তারা আমরা ১৪ নং ওয়ার্ডবাসী দেখবো।
সূত্র মতে, মেয়র কামরান আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কৌশলে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তার উদ্দেশ্য সিলেট আওয়ামীলীগে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে এবং তার সমান্তরালে কোন নেতা সৃষ্টি হোক, তা তিনি চান না। এ কারণেই আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই বিকল করে রেখেছেন তিনি। দলকে সুসংগঠিত করতে কখনই তিনি কোন উদ্যোগ নেননি। গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়া সিলেটে আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি পালিত হয়নি। দল প্রধান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সানিধ্যে থাকতে তিনি ব্যাকুল থাকতেন। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে লন্ডনসহ আরো কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। মূলত: ২০০৮ সালে জেল থেকে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর কামরান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি গোচর হোন।
কামরানের ঘনিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, সিলেট আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদের ক্ষমতায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদের গ্রুপ করতেন। পরবর্তীতে সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর এ গ্রুপের হাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ইফতেখার হোসেন শামীম এর আওতাধীন থাকলেও শামীমের অকাল মৃত্যুর কারণে এ গ্রুপের হাল ধরেন নগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মেয়র বদর উদ্দিন কামরান। পাশাপাশি নগর আওয়ামী লীগ নেতা ও বিদায়ী সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও সাবেক ছাত্রনেতা রঞ্জিত সরকারের গ্রুপকে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন বলে জানা যায়। আজাদ ও রঞ্জিত গ্রুপের বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই বারবার এমসি কলেজে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় বলে অভিযোগ আছে। অস্ত্রের মহড়ায় প্রায়ই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এমসি কলেজ। এই গ্রুপটিই এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসটি পুড়িয়েছে বলে জানা গেছে। আর তাদের এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পরোক্ষভাবে মদদ দেন মেয়র কামরান। অথচ সিলেট আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মীই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থন করে না। তাই আজাদ-রণজিৎ গ্রুপকে প্রশ্রয় দিয়ে কামরান বারবার সমালোচিত হচ্ছেন।
এদিকে কামরানের ঘনিষ্ঠ আরো একটি সূত্র জানায়, দলীয় নেতাদের সঙ্গে কামরানের দূরত্ব তৈরি হওয়ার অন্তরালের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বিগত জোট সরকার ও পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সমাধান বা মীমাংসার কোন উদ্যোগ নেননি তিনি। এ পরিস্থিতিতে আগামীতে সরকার পরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এলাকায় থাকতে পারবেন না মনে করে অনেক নেতাকর্মীই আতঙ্কে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা মামলাগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে দফায় দফায় কামরানকে অনুরোধ জানালেও তিনি এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেননি। এ কারণে জেলা ও মহানগর কমিটির নেতারা তার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ।
প্রাপ্ত সূত্র মতে, সাবেক মেয়র কামরান একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সঙ্গে চলাফেরা করেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এটি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রয়েছে কামরানের নিবিড় সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে কামরানের ব্যবসা-বাণিজ্যও রয়েছে বলে জানা গেছে। তার এসব কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এদিকে সিলেট নগরবাসীরা আড়ালে বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানকে ‘মিস্টার থ্রি পার্সেন্ট’ বলে অভিহিত করে। যে কোনও কাজ পাওয়ার আগেই কামরানকে পুরো কাজের শতকরা তিনভাগ টাকা অগ্রিম দিতে হয় বলেই তার এমন নামকরণ বলে জানা গেছে। তবে এভাবেই বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন তিনি। এ নিয়ে জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিনিয়তই বিব্রত হতে হয়।
সিলেট নগরীর অনেক বয়জৈষ্ঠদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, কামরান কোন কিছুতে না বলতে নারাজ। এবং সেই সাথে সুন্দর হাসিতে অভ্যস্থ। তাবে কাজের নামে ভাংঙ্গা হাড়ির সাথে তুলনা করেন তারা। তারা আরো বলেন, অনেক রাগ করেও তারা সাথে পারা যায় না। তার অমায়িক সুন্দর কথা যেন কোন ভাবেই ফেলা যায় না। আবার অনেক নগরবাসী জানান, তারা অনেক উপকৃত হয়েছেন সদ্য সাবেক এই মেয়রের অবদানে। তবে তারা অকপটে আরো বলেন, এতে হয়তো মেয়রের কোন স্বার্থ ছিল যা আমদের প্রকাশ করা হয়ণি বা আমাদের বুঝতে দেয়া হয়নি।
বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, আসন্ন সিটি নির্বাচনে মেয়র কামরান মনে করেন যে দলীয় নেতাকর্মীরা তার সঙ্গেই আছেন। তিনি দাবি করে বলেন, বিএনপিতে বিরোধ থাকলেও আওয়ামী লীগে কোন বিরোধ নেই। আওয়ামী লীগে কোন বিভাজন নেই। দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীই তাকে জয়ী করার জন্যে মনে প্রাণে কাজ করছেন। কিন্তু সরেজমিনে সিলেট নগরীর দৃশ্য দেখা গেল অন্যরকম। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষোভের কারণে তিনি এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ মিটে গেলে কামরানকে বিজয়ী হওয়ার জন্যে কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। সেই লড়াইয়ে কে জিতবেন তা দেখার জন্যে এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সিলেট নগরবাসী।
প্রসঙ্গত: নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে কয়েকদিন আগে বন্দর বাজার মসজিদে ফরজ নামাজ আদায়ের পর উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে কামরান বক্তব্য দিতে গেলে মুসল্লিদের তোপের মুখে পড়েন। এ সময় বিভিন্ন ধরনের বাজে উক্তি করে ধিক্কার দেন একজন ব্যর্থ মেয়র হিসেবে এবং আওয়ামীলীগের সক্রিয় একজন ব্যর্থ রাজনীতবিদ হিসেবে।
Leave a Reply