মুকিত চৌধুরী: ইন্ডিয়ান সিলেটির বাসস্থান মূলতঃ ভারতের আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ জেলায়। যদিও তার বিস্তৃতি শিলচর পর্যন্ত যায়। আজকের লেখার আলোচ্য বিষয় কি করে সিলেট বিভাগের করিমগঞ্জ মহুকুমা ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। ভুমিকায় জেনে নেয়া ভাল ১৩২৮ সনে হজরত শাহ জালাল (রাঃ) সিলেট জয়ের পর করিমগঞ্জের বেশিরভাগ অংশ বেঙ্গল সালতানাতের মধ্যে আসে।
করিমগঞ্জ হলো সিলেটের জকিগঞ্জ, বিয়ানিবাজার, এবং কানাইঘাটের প্রতিবেশী। ১৮৭৪ সালে বৃটিশরা আসাম এবং সিলেট নিয়ে গঠন করে নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টটিয়ার নামে নতুন শাসনব্যবস্থা যাকে বলা হলো ‘আসাম প্রদেশ’। ঐতিহাসিক ভাবে সিলেট ছিল পুর্ব বাংলার অংশ এবং পুরো করিমগঞ্জ মহুকুমা শহর ছিল সিলেট বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। বৃটিশ ঐ অঞ্চলে উন্নয়ন কাজের জন্য পূর্ব বাংলার বিশেষ করে বৃহওর সিলেট এবং ময়মনসিংহ থেকে লোকবল নিয়ে এসে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকায় জনবসতি স্থাপন করে। ফলে ঐ অঞ্চলে গড়ে উঠে একটি বাংলাভাষী অঞ্চল।
এভাবে চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৭-এ শুরু হলো ভারত বিভক্তিকরণের প্রক্রিয়া। আসাম শুরুতেই ভারতের সাথে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং আসামিরা শুরু থেকেই বাঙ্গালী হটাও আন্দোলন করে আসছিল। অসমিয়া’রা মুলত ছিল এক ধরনের উপজাতীয় লোক। যাদেরকে বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় বলা যেতে পারে আদিবাসী। যদিও বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলে আসামিজদের সংখ্যা ছিল নগন্য। প্রশ্ন আসলো সিলেট বিভাগ নিয়ে। কোথায় দেয়া হবে সিলেট বিভাগ। জনমত যাচাইয়ের জন্য ৬-৭ জুলাই ১৯৪৭ এ দেওয়া হলো গণভোট । সিলেটের ৫৬.৬% জনগন ভোট দেয় পূর্ববাংলার সাথে যুক্ত হতে।
সিলেট পূর্ব বাংলায় ফিরে আসাটা ছিল সিলেটের জন্য আশীর্বাদ আবার পূর্ব বাংলার জন্য সিলেট ফিরে পাওয়াটা ছিল আশীর্বাদ। আজ বাংলাদেশী সিলেটিরা ইন্ডিয়ান সিলেটিদের চেয়ে হাজার গুন এগিয়ে। সুতরাং আমি ‘সিলেটি সালাম’ জানাই সেই সিলেটিদের যারা ঐ দিন ভোট দিয়েছিলেন আদি বাসস্থান পূর্ব বাংলায় ফিরে যেতে। নিঃসন্দেহে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল বর্তমান সিলেটের জন্য হজরত শাহজালালের (রাঃ) এর দোয়া। দেখা যাক কেমন করে সিলেটের করিমগঞ্জ বিচ্ছিন্ন হলোঃ ঐ সময় করিমগঞ্জের এক নেতা ছিলেন তাঁর নাম আব্দুল মুতালিব মজুমদার (জন্ম হাইলাকান্দি)।
তিনি ১৯২১ সলে ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। পেশায় ছিলেন উকিল আবার ছিলেন মেম্বার অফ লোকাল এসেম্বলি (এম, এল, এ) এবং আসাম সরকারের মন্ত্রীসভার স্থানীয় সরকার, পশু ও কৃষি মন্ত্রী। তিনি ফকরুদ্দিন আলী আহমেদ (ভারতের পঞ্চম রাষ্টপতি, তিনিও ছিলেন একজন আসামি’জ মুসলিম এবং আসাম থেকে কংগ্রেসের লোকসভার সদস্য) এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সবাই ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। যখন তা ঠেকানো গেল না, তারা চেষ্টা করলেন পূর্ববাংলা যেন ‘পাকিস্থান’ রাষ্টে যোগ না দেয়। তাও যখন হলো না মজুমদার সাহেব এবং বাসন্ত কুমার দাস (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাম) মিলে ‘শিলচরে’ দুইবার আসাম ন্যাশনাল কংগ্রেস মিটিং করেন এবং বুঝাবার চেষ্টা করেন সিলেট যেন পূর্ব বাংলায় না যায়।
কিন্তু তারা মুসলিম জনগোষ্ঠিকে বুঝাতে ব্যর্থ হন, জনগন রায় দেয় পূর্বের বাসস্থানে ফিরে যেতে। শেষ পর্যন্ত মজুমদার সাহেব উপায়ান্তর না দেখে ‘রেডক্লিফ কমিশনকে’ (ভারত বিভক্তিকরণের ভুমি জরিপ কমিটি) অনুরোধ করেন সিলেটের করিমগঞ্জ মহুকুমা যেন ভারতে দিয়ে দেয়া হয় যদিও সংখ্যায় বেশী মুসলমান এবং জনমতের বিরুদ্ধে। মজুমদার সাহেবের মাথায় কি এসেছিলো ঐ সময় কে জানে, তবে জনমত উপেক্ষা করে তিনি করিমগঞ্জকে ভারতে রাখার অনুরোধ করলেন এবং সার্থক হলেন। ‘রেডক্লিফ কমিশন’ অনেক উল্টা-পাল্টা কাজ করেন, যেমন ধর্মের হিসাবে মালদাহা এবং মুর্শিদাবাদ দেয়ার কথা ছিল পূর্ব বাংলাকে, কিন্তু দিয়ে দিলেন ভারতকে। তার এই কর্মকাণ্ডকে তারই দলিল লেখক জনাব বেন্তন বলেছেন ‘রেডক্লিফের ঘরে বাতি ছিল না’।
তার পক্ষপাত দুষ্ট কাজের মাশুল গুনছে ইন্ডিয়ান সিলেটিরা। আজো মাটির টানে কাঁদছে, না পারছে ছাড়তে, না পারছে সইতে। এর সাথে যোগ হয়েছে বি,এস,ফ এবং বর্ডার গার্ড। পূর্বেই বলেছি মজুমদার সাহেবের জন্ম হয়েছিলো হাইলাকান্দি (করিমগঞ্জের পূর্বে) তাই এই ধারণা অনুমেয় তিনি তা চেয়েছিলেন নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে। তবে এই কানমন্ত্রের পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল ঐ অঞ্চলে নাকি ভোট জালিয়াতি হয়েছে। এই ছিল সংক্ষেপে করিমগঞ্জ মহুকুমা ফেলে আসার ইতিহাস। কিন্তু প্রশ্ন হলো গনতন্ত্রের ধারক বাহক বৃটিশরা কি করে মজুমদার, ফকরুউদ্দিন এবং বাসন্ত কুমার দাসের কথায় এ অপকর্মটি করলো?
আসাম কিন্তু সিলেটিদের গণভোটে খুশী হয়েছিল। আদিবাসী আসামিজরা চেয়েছিল করিমগঞ্জ যেন পূর্ব বাংলায় চলে যায়। তাহলে ইন্ডিয়ান সিলেটি এ বিষয়টি বৃটিশদের প্রশ্ন করতে পারে কেন গণতন্ত্র বিরোধী সিদ্দান্ত নেয়া হলো ঐ দিন। পূর্বেই বলেছি যদিও ইন্ডিয়ান সিলেটির বাসস্থান করিমগঞ্জে কিন্তু এর বিস্তৃতি গড়ায় কাছাড় জেলার শিলচর পর্যন্ত। পাঠকদের অবগতির জন্য ঐ অঞ্চলের বাঙ্গালীরা আবার বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন সিলেটি লোকদের বলা হয় ‘সিলেটি মুসলমান’, ময়মনসিংহের লোকদের বলা হয় ‘মিয়া মুসলমান’ আর হিন্দুদের বলা হয় ‘বাঙ্গালী হিন্দু’।
আজ সিলেটি ইন্ডিয়ানরা কেমন আছে। করিমগঞ্জ জেলা বাংলাভাষী হওয়ায় এ জেলা ‘সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ে’র অন্তর্ভুক্ত। তাদের রিপোর্ট অনুসারে করিমগঞ্জের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুবই নাজুক। ভারতের অনুন্নত জেলার মধ্যে একটি অন্যতম। সমগ্র জেলার ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা, আর প্রাপ্তি ১০ মেগাওয়াট। চাহিদা
এতো কম কেননা কারখানা নেই বললেই চলে। এখনও ম্যালেরিয়ায় মৃতের পরিমাণ অনেক। সারা জেলার ৮৫৭ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে মাত্র ১২১ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। জেলার ৯০ ভাগ মানুষ এখনও কাচা বাড়িতে থাকে। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। সেনিটেশন ১৬%। লেখাপড়ায়ও পেছনে কেননা ক্ষুদ্র বাঙ্গালী গোষ্ঠী (সিলেটি বাংলা) না হতে পাড়ছে আসামি’জ, না ইন্ডিয়ান, না বাঙ্গালী। পার্শ্ববর্তী বড় শহর গুহাটি। কিন্তু সেখানে গেলে আবার বাঙ্গালী হটাও অন্দোলনের শিকার। তাহলে কি পেলো ঐ অঞ্চলের সিলেটি? বলা যেতে পারে জিরো উন্নয়ন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বাসিন্দা। ভারত নিঃসন্দেহে ভাল দেশ কিন্তু আসাম যখন নিজেদের আদিবাসী মনে করে যা মুক্তমনা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী মানুষের জন্য তাহয় অস্বস্তিকর।
১৯৪৭ সনের পর বহু লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে সত্য মূলত ধর্মের টানে, কিন্তু করিমগঞ্জবাসী মত প্রকাশ করেও বঞ্চিত হলো পূর্ব বাংলার সাথে একত্রিত হতে। ভারত একটি বহু সংস্কৃতির দেশ, বহু ভাষার দেশ, বহু গোত্রের দেশ। করিমগঞ্জের সিলেটিরা গোত্র বেষ্টিত আসামি’জ দ্বারা প্রভাবিত হয়তো একদিন ইন্ডিয়ান সিলেটি এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হারিয়ে যাবে আদিবাসীদের মাঝে।