নিউজ ডেস্ক: বিভিন্ন কারণে সিলেট জুড়ে আলোচিত তিনি। তার তল্পিবাহকরা তাকে দানবীর বলে প্রচার করেন। কেউ কেউ তাকে বলেন অবৈধ সম্পদের দানবীর। সিলেট নগর ও আশপাশের এলাকায় তার নামের আগে নানা বিশেষণযুক্ত সাইনবোর্ড-ব্যানার চোখে পড়ে। তাকে নিয়ে কবিতা-প্রবন্ধ লেখার জন্য আছে বেতনভুক্ত কবি-সাহিত্যিক।
কোনো অনুষ্ঠানে তাকে সংবর্ধনা দিলে বা তার গুণকীর্তন করা হলে মেলে মোটা অংকের টাকা। তিনি হলেন সিলেটের ভূমিদস্যু রাগিব আলী। এ দানবীর শিল্পপতির অর্থের উৎস নিয়ে জনমনে রয়েছে শত জল্পনা-কল্পনা। সিলেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার সম্পত্তির পরিমাণ নিয়েও রয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ।
জালিয়াতি করে হাজার কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি দখল নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। তবু রহস্যজনক কারণে রাগিব আলী রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাগিব আলী বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় পালিয়ে লন্ডনে আত্মগোপন করেছিলেন। সরকারি সম্পত্তি দখল ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি হয়ে রাগিব আলী এখন দানবীর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দুই হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি দখল: সুত্র জানায়, দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান প্রতারণার মাধ্যমে লিজ নেন রাগিব আলী। লিজের শর্ত ভঙ্গ করে চা বাগান ধ্বংস করে গড়ে তুলেন হাউজিং প্রকল্প ও নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাগানটিতে নিজ নামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও গড়ে তুলেছেন তিনি। চা বাগান দখলের ঘটনায় গঠিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন ও প্রতারণা মামলার এজাহারে তারাপুর চা বাগান নিয়ে রাগিব আলীর নানা জালিয়াতির চিত্র প্রকাশ পায়।
মামলায় বলা হয়েছে, ৮০০ কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন রাগিব আলী। তবে ২০০৫ সালে মামলা করার সময় ৮০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে ওই জমির বাজার মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জালিয়াতির অভিনব কৌশল: সুত্র জানায়, ১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তারাপুর চা বাগানসহ তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউর দেবতার নামে রেজিস্ট্রি দানপত্র করে দলিল করেন। তখন থেকে এ সম্পত্তিটি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল।
তারও আগে এ বাগানটি তৎকালীন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত জনসন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত এ দেবোত্তর সম্পত্তিটির সেবায়েত নিযুক্ত হন। রাজেন্দ্র গুপ্ত প্রাণ হারালে তার পুত্র পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বাগানটির সেবায়েতের দায়িত্ব পান। পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ভারত চলে গেলে কথিত পাওয়ার অব এটর্নি মূলে দেবোত্তর সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান রাগিব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্বীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদ।
একজন মুসলমান ব্যক্তিকে দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত করা হয় ‘পাওয়ার অব এটর্নি’ জালিয়াতির মাধ্যমে। এরপর এ মোস্তাক মজিদই রাগিব আলীর পুত্র আবদুল হাইকে ৯৯ বছরের লিজ প্রদান করেন বাগানটি। সহকারী সচিবের স্বাক্ষর জাল: সুত্র জানায়, শুধু পাওয়ার অব এটর্নি জালিয়াতি নয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মির্জা ফজলুল করিমের স্বাক্ষর জাল করে ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদান করা হয় তারাপুর চা বাগান (ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ভূঃ মঃ/শা-৮/খাজব ৫৩/৮৯)।
এ বাগান উদ্ধারের গঠিত সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে মির্জা ফজলুল করিম জানান, আদেশের কপিতে যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তিনি করেননি। আদেশের কপিতে উল্লিখিত শাখা ৮-এ শাখা অফিসার হিসেবে তিনি কখনই দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি কমিটিকে জানান, পুরো বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রনোদিত, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান আত্মসাতের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়েরের সুপারিশ করে।
এরপর রাগিব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। রাগিব আলীর পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা: সুত্র জানায়, প্রতারণার মাধ্যমে ভূ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাগিব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তৎকালীন সিলেট সদর ভূমি কমিশনার এসএম আবদুল কাদের কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেন। নং-১১৭/০৫। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, রাগিব আলী নিজ স্বার্থে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে জাল আমমোক্তারনামা তৈরি করেছেন।
তিনি তারাপুর চা বাগান আত্মসাৎ করার জন্য জাল অনুমতিপত্র এবং সন্দেহজনক আমমোক্তারনামার বলে নিজের লোক দিয়ে আবদুল হাইয়ের নামে বিক্রি রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছেন। দেওয়ান মোস্তাক মজিদ ৪ জনকে দিয়ে একটি আমমোক্তারনামা তৈরি করেন। তারাপুর চা বাগান আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই নিজের লোকদের দিয়েই আমমোক্তারনামার বলে আবদুল হাই বিক্রি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেন। মামলায় রাগিব আলী ছাড়াও তার মৃত স্ত্রী রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, পুত্র আবদুল হাই, কন্যা রেজিনা কাদির, জামাতা আবদুল কাদির, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দেওয়ান আবদুল মজিদ ও সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে আসামি করা হয়। রাগিব আলী ও প্রশাসনের বক্তব্য: প্রতারণার এ মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত আছে।
কিন্তু রাগিব আলী দখল করা দেবোত্তর সম্পত্তিতে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছেন। হাজার কোটি টাকার ভূ-সম্পত্তি উদ্ধারে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না প্রশাসন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, এ সংক্রান্ত মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত আছে। বিধি অনুযায়ী সরকার সলিসিটারের মাধ্যমে মামলা লড়ছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর জেলা প্রশাসন জমি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কোটি টাকার জমি জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পপতি রাগিব আলী বলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জমি দখলের অভিযোগ করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে চা বাগানের জমি ইজারার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। নিয়ম মেনে আইন অনুযায়ী জমি লিজ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় ভূমি প্রশাসন জমির বিষয়ে যে মামলা করেছে তা এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন।
তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। চা বাগানের জমিতে বহুতল ভবনসহ স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে রাগিব আলী বলেন, যে সব জায়গায় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে পাথুরে টিলা ছিল। তাই সেখানে চা চাষ করা যেত না। এসব জায়গায় মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।