ডেভিড বার্গম্যান: নিউ এজ যখন সুখরঞ্জন বালীর বিবৃতির ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় তখন পত্রিকাটি জানতো বাংলাদেশের সরকার এবং মিডিয়া, বিশেষত মিডিয়ার একাংশ যারা রাজনীতিকে সাংবাদিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয় তারা এ প্রতিবেদনকে হেয় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। বিবৃতিতে সুখরঞ্জন নিশ্চিত করেছিলেন তাকে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটক থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। তবে এটা বলা যায়, প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর দু’টি ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুমের বিষয়টি, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে বর্তমান সরকারের আমলে এ সংখ্যা ৭০ ছাড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, যা বিপুল জনসমর্থন নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, সে ট্রাইব্যুনালের সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া। অতএব, আমরা ঢিলের বদলে পাটকেলের চেয়ে বেশি কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তবে এ আক্রমণের জন্য বিবিসি বাংলা সার্ভিসের ট্রয়ের ঘোড়া হওয়া ছিল বিস্ময়কর। এ নিয়ে বিবিসির প্রকাশিত প্রতিবেদন শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, পক্ষপাতদুষ্ট। সে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ও জনকণ্ঠ। অন্যান্য প্রধান সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিও ছিল বিবিসির প্রতিবেদন। কোন সাংবাদিকতাই সমালোচনামূলক পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম কখনও কখনও পক্ষপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু মানুষ বিবিসি বাংলার কাছ থেকে ভিন্ন কিছু আশা করে, বিবিসি সম্পাদকীয় নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যে নীতিমালার মূল কথা হচ্ছে নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং স্বচ্ছতা। বিবিসি বাংলা সার্ভিস এ ঘটনায় দু’টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে দু’টিই সংবাদ প্রতিবেদন, মন্তব্য বা ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন নয়। বিবিসির দু’টি প্রতিবেদনেই নিউ এজ অথবা সুখরঞ্জন বালীর দেয়া বিবৃতির কথা বলা হয়নি। এমনকি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতির ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি। আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংগঠনের সংবাদ বিবৃতে বলা হয়, বাংলাদেশী নাগরিক সুখরঞ্জন বালী দাবি করেছেন তাকে বাংলাদেশের পুলিশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাইরে থেকে অপহরণ করে। তাকে বাংলাদেশে বন্দি রাখার পর বাংলাদেশী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত পার হতে বাধ্য করে। তিনি অভিযোগ করেছেন, কলকাতার দমদম কারাগারে পাঠানোর আগে বিএসএফ তাকে নির্যাতন করে। দু’টি প্রতিবেদনেই বিবিসি নামহীন গোয়েন্দা সূত্রের কথা উল্লেখ করেছে। বিবিসির প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা সূত্রে বিবিসির সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী জানতে পেরেছেন, দমদম কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে বালীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মি. বালী কারা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, অর্থের লোভ দেখিয়ে এক কারারক্ষীর মাধ্যমে তিনি এ বিবৃতি বাইরে পাঠিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্র আরও জানিয়েছে, ‘বালীর মতে ওই কারারক্ষী সীমান্ত এলাকায় যান এবং চিঠিটি একজন স্মাগলারের কাছে হস্তান্তর করেন।’ একই ধরনের তথ্য বিবিসির দ্বিতীয় প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে। কারারক্ষী, অর্থ এবং স্মাগলারের ব্যাপারটি এমন ধারণা দেয়, পুরো বিষয়টি অন্ধকারাচ্ছন্ন, এমনকি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অবৈধ। এটা লক্ষণীয় যে বিবিসির প্রতিবেদনে সংবাদদাতা বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন। তিনি এ কথা বলেননি, গোয়েন্দা সূত্র দাবি করেছে। নামহীন সূত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবিসির কঠোর নীতিমালা রয়েছে। যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং যাদের সংবাদপত্রকে কোন একটি বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থ জড়িত তাদের ব্যাপারে নামহীন সূত্র ব্যবহার করা যায় না। গোয়েন্দা সূত্রের যে দাবি করা হয়েছে তা নিউ এজে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বিবিসির প্রতিবেদক কেন নিউ এজের সঙ্গে জবাবের জন্য যোগাযোগ করলেন না তা একটি প্রশ্ন। যদি যোগাযোগ করা হতো তাহলে বিবিসিকে এটা নিশ্চিত করা হতো যে, বিবৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন স্মাগলার, কারারক্ষী অথবা অর্থের বিষয় জড়িত ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিবিসির দু’টি প্রতিবেদনই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নয়। বাংলাদেশে বিবিসি বাংলার সম্মানজনক অবস্থান রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের বিচ্যুতি ঘটেছে। তাদের তা স্বীকার করা উচিত এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেতে কাজ করা উচিত। সে সামর্থ্য তাদের রয়েছে। ২০১২ সালের ৫ই নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটক থেকে নিখোঁজ হন সুখরঞ্জন বালী। গত ১৬ই মে তার ভারতের কারাগারে আটক থাকার ব্যাপারে সর্বপ্রথম সংবাদ প্রকাশ করে নিউ এজ। পরদিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করে। ডেভিড বার্গম্যান: বৃটিশ মানবাধিকার কর্মী এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিক। বাংলাদেশের নিউ এজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদন বিষয়ক সম্পাদক। লেখাটি bangladeshwarcrimes.blogspot.com থেকে নেয়া।
Leave a Reply